হরহামেশা ঘটছে লাইনচ্যুতি কারও জবাবদিহি নেই
অনলাইন ডেস্ক :
রেলের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এ কারণে দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। যেখানে-সেখানে হরহামেশা ট্রেনের লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। রোববার রাতে গাজীপুরের ধীরাশ্রমে ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনা আবারও সেটাই প্রমাণ করল। হাজারখানেক যাত্রী নিয়ে দ্রুতযান এক্সপ্রেস খুব সামান্য গতি নিয়ে লুপ লাইন থেকে মেইন লাইনে ওঠার সময় দুর্ঘটনাকবলিত হয়। এতে তিনটি কোচ লাইনচ্যুত হয়। এর মধ্যে দুটি আবার উলটে যায়।
ধীরাশ্রম রেলওয়ে স্টেশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, যেখানে ট্রেন লাইনচ্যুতি হয়েছে, সেখানকার লাইনে পাথর নেই। ধীরাশ্রম রেলওয়ে স্টেশন এবং আউটার পর্যন্ত লুপ লাইনের স্লিপারগুলো কাঠের। এগুলো যুগের পর যুগ জরাজীর্ণ। অথচ প্রতিবছর এ লুপ লাইনের সংস্কার দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা লুটপাট করা হয়। মেইন লাইনের স্লিপারগুলো পাথরের। ট্রেন যখন মেইন লাইন থেকে লুপ লাইনে গিয়ে দাঁড়ায়, তখন লাইন দেবে যায়। রোববার দ্রুতযান লুপ লাইন থেকে মেইন লাইনে ওঠার সময় তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়। দুটি বগি উলটে যায়। ধীরগতিতে উলটে যাওয়ায় মারাত্মকভাবে কেউ আহত হয়নি।
সোমবার পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের রেললাইনের দায়িত্বে থাকা প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিয়া যুগান্তরকে বলেন, এমন দুর্ঘটনা প্রায় ঘটছে? দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট পেলেই সব জানা যাবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবেক প্রকৌশলী জানান, কেবল জরাজীর্ণ রেলপথের কারণে ৮৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা সব সময় বিষয়টি এড়িয়ে যান। আর প্রধান প্রকৌশলীর কিছুই যায়-আসে না। কারণ দুর্ঘটনার জন্য প্রধান প্রকৌশলীকে কখনো দায়ী করা হয় না। দুর্ঘটনায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কোনো জবাবদিহি না থাকায় তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমান।
ধীরাশ্রমে দুই মাসে ১১টি লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। ১৬ জুলাই জয়দেবপুরে একতা এক্সপ্রেস ট্রেনের দুটি কোচ লাইনচ্যুত হয়। ১২ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি তেলবাহী ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়। ২৩ জুলাই কুষ্টিয়ায় তেলবাহী তিনটি ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়। এতে প্রায় ৫০ টন তেল মাটিতে পড়ে যায়। ৫ জুন জয়দেবপুরে একটি লোকাল ট্রেনের দুটি কোচ লাইনচ্যুত হয়। ১৬ জুন রাজেন্দ্রপুর এলাকায় যাত্রীবাহী ভাওয়াল এক্সপ্রেস ট্রেনের দুটি কোচ লাইনচ্যুত হয়।
রেলওয়ের যন্ত্র প্রকৌশলী দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, একটি ট্রেন যতই মেয়াদোত্তীর্ণ হোক কিংবা ত্রুটি থাকুক, সেটাকে ঠেলে অথবা কোনো পদ্ধতিতেই লাইনচ্যুত করা সম্ভব নয়। কিন্তু রেলপথ জরাজীর্ণ হলে সহজেই রেল লাইনচ্যুত হয়। রেলপথ জরাজীর্ণ হওয়ায় এমন দুর্ঘটনা প্রায় ঘটছে। কিন্তু দায়িত্বে থাকা প্রধানদের কাউকেই জবাবদিহির মধ্যে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, শুধু মেইন লাইন নয়, লুপ লাইনও যথাযথ মেরামত-সংস্কার করার কথা। লাইনে পাথর দেওয়াসহ স্লিপার, হুক যথাযথভাবে স্থাপন করার নিয়ম।
কিন্তু এমনটা কোনোকালেই করা হয় না। গত দেড় বছরে রেলের দুই অঞ্চলে প্রায় ৬০ কোটি টাকার পাথর লাইনে ফেলা হয়েছে। এ পাথর ফেলা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এদিকে প্রতিনিয়ত এমন দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রতিকারের যথাযথ পথ না খুঁজে রেলওয়েসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও দপ্তর একে অপরকে দোষ দিচ্ছে। নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। দুর্ঘটনার পরপরই দুই থেকে পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু কমিটির সুপারিশ আলোর মুখ দেখে না। কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, রেলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। জরাজীর্ণ লাইনের কারণেই বেশির ভাগ লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটে। রেলে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও লাইনের প্রতি কারও নজর নেই। কিন্তু লাইনের শতভাগ নিরাপদ নিশ্চিত করতে হবে। লাইনচ্যুতির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি।
সোমবার রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন যুগান্তরকে বলেন, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবহেলায় এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।