অনিশ্চিত ভাঙ্গা-কুয়াকাটা ফোর লেন প্রকল্প : সরু সড়কে নিত্য দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ
অনলাইন ডেস্ক :
কেউ না বুঝলেও বুঝেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু চালু হলে যানবাহনের চাপ বাড়বে বুঝেই ৬ বছর আগে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়কটি ৪ লেন করার ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন তিনি। কিন্তু সড়ক বিভাগের দীর্ঘসূত্রতায় ৬ বছরে বলতে গেলে কিছুই হয়নি। এরই মধ্যে পরপর তিনবার ফেরত গেছে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ হওয়া টাকা।
২৬ জুন পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হওয়ার পর ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা পর্যন্ত অনেক নতুন বাস নেমেছে। সাকুরা পরিবহণেরই ৭০টি বাস চলছে এই পথে। এসেছে গ্রিনলাইন, শ্যামলী, হানিফ, ইলিশসহ বিভিন্ন বিখ্যাত কোম্পানির কয়েক শ বাস। বাড়তি এই যানবাহনের চাপ এখন ১৯৫ কিলোমিটার সড়ক সামলাতে পারছে না অপ্রশস্ত হওয়ার কারণে। ফলে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। এক হিসাবে দেখা যায়, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ১ জুলাই থেকে ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে মাত্র ২৫ দিনে ভাঙ্গা-কুয়াকাটা মহাসড়কে ১৩টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ জন। আহত হয়েছেন দুইশরও বেশি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইমেজ অ্যান্ড ইনফরমেশনের নির্বাহী পরিচালক হাসান আবিদুর রেজা বলেন, ‘১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে নির্মিত এই সড়কটির প্রস্থ ছিল মাত্র ১২ ফুট।
১৯৮৮ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এর প্রস্থ বাড়িয়ে ১৮ ফুট করে সড়ক বিভাগ। সর্বশেষ ২০১৮-১৯-এর দিকে আরও ৬ ফুট বাড়লে এর প্রস্থ দাঁড়ায় ২৪ ফুট। অবাক করা বিষয় হলো, দক্ষিণের প্রবেশদ্বার এই সড়কটির ওজন ধারণক্ষমতা এখনো ৫ টন। এর বেশি ওজনের যানবাহন চলাচলের উপযোগী নয় সড়কটি।’ বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে বলেন, ‘৬২ বছরের ইতিহাসে সড়কের প্রস্থ বেড়েছে মাত্র ১২ ফুট। তাও আবার ধারণক্ষমতা ৫ টন। এই একটি তথ্যই প্রমাণ করে কতটা অবহেলিত এই অঞ্চল। দীর্ঘ এই সময়ে এখানকার জনসংখ্যা যেমন কয়েক কোটি হয়েছে, তেমনই যানবাহনের সংখ্যাও বেড়েছে হাজার গুণ। প্রধানমন্ত্রী ৬ বছর আগেই বলেছিলেন সড়ক প্রশস্তের ব্যবস্থা নিতে। অথচ তা করেনি সড়ক বিভাগ। ফলাফল-প্রতিদিন মৃত্যু।
এজন্য যারা দায়ী, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।’ বাস মালিক সমিতির নেতার এই বক্তব্যের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক ৪ লেন করার প্রাথমিক কাজ শুরু করে সড়ক ও সেতু বিভাগ। ২০১৮ সালে প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত করার পর অনুমোদনের জন্য তা তোলা হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ একনেক সভায়। ওই বছরের ১১ অক্টোবর পাশ হওয়া প্রকল্পে ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত ১৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ৬ লেন বিশিষ্ট এক্সপ্রেস সড়ক নির্মাণের অনুমোদন দেয় সরকার। সড়ক নির্মাণে প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ হাজার ৮৬৭ কোটি ৮৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
প্রকল্প অনুযায়ী বিপরীতমুখী ডাবল লেনের দুটি সড়কসহ ধীরগতির স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা দুটি সার্ভিস লেন করার অনুমোদন দেয় একনেক। সড়কটি হবে ১৭০ ফুট চওড়া। মিডল থেকে উভয় পাশে যাবে ৮৫ ফুট করে। সড়কের টপ উইথ হবে ১১ ফুট। ১১ অক্টোবর পাশ হওয়া ওই প্রকল্প প্রস্তাবে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে শেষ করতে বলা হয় জমি অধিগ্রহণের কাজ। কিন্তু ২০২০ তো দূরের কথা, ২০২২ এর মার্চে এসেও সেই কাজ শুরু করতে পারেনি সড়ক ও সেতু বিভাগ। ইতোমধ্যে তিনবার ফেরত গেছে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ হওয়া অর্থ।
এ প্রসঙ্গে সড়ক ও সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাসুদ খান বলেন, ‘সড়ক নির্মাণে ঠিক কতটুকু জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, তা চিহ্নিত করার দায়িত্ব পাওয়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ভুলের কারণে এই দীর্ঘসূত্রতা। জমি চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে একদিকে যেমন তারা সর্বশেষ ম্যাপ পর্চা ব্যবহার করেনি; অন্যদিকে অধিগ্রহণ প্রস্তাবনার জমি চিহ্নিতকরণে ছিল ত্রুটি। ১৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক প্রশস্তকরণে তারা প্রস্তাব করেছে মাত্র ৩০২ একর জমি অধিগ্রহণের। বিষয়টি নিয়ে খটকা লাগায় পরে যখন আমরা নিজস্ব সার্ভেয়ার দিয়ে জরিপ করি, তখন দেখা যায় জমি লাগবে ১ হাজার ৯১ একর। এভাবে নানা ভুলের কারণে নির্ধারিত সময়ে শুরু করা যায়নি অধিগ্রহণ।’
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে সড়ক বিভাগের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘দপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তার গাছাড়া ভাবের কারণেই মূলত এত দীর্ঘ সময়েও শুরু হয়নি কাজ। বরিশাল ও ঢাকার সমন্বয়ের অভাবও এক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা বাড়িয়েছে। সেই সঙ্গে করোনা মহামারির অজুহাত তো ছিলই। এদিকে নতুন করে জটিলতা দেখা দিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের অর্থ সংস্থান নিয়ে। শুরুতে এই প্রকল্পে সহায়তার কথা বলেছিল এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এডিবি। বর্তমানে তারাও আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।’
প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে আলাপকালে সড়ক বিভাগ বরিশালের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এবং আলোচ্য প্রকল্পের পরিচালক একেএম আজাদ রহমান বলেন, ‘পুরোদমেই চলছে ৪ লেন সড়ক বাস্তবায়নের কাজ। সড়ক নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জমি চিহ্নিত করার কাজ শেষ করেছি আমরা। এসব জমি অধিগ্রহণে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ এবং বরিশালের জেলা প্রশাসনকে। পটুয়াখালী জেলায় জমি চিহ্নিত করার বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত না হওয়ায় সেখানে অবশ্য অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করতে পারিনি আমরা। জমি অধিগ্রহণ শুরু করতে ফরিদপুর ও মাদারীপুরে ১১টি ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন কেস খোলা হয়েছে। গোপালগঞ্জ ও বরিশালেও ৫টি ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন কেস খোলার প্রস্তুতি চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি অর্থবছরেই উল্লিখিত জেলাগুলোয় জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ করতে পারব আমরা।’
এখন পর্যন্ত কতটুকু জমি অধিগ্রহণ হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রক্রিয়া চলছে।’ জমি অধিগ্রহণ প্রশ্নে গত অর্থবছরে বরাদ্দ হওয়া ৩৭১ কোটি টাকার ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই টাকা সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনগুলোকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ হওয়া কোনো টাকাই এবার আর ফেরত যায়নি।’ সড়ক ও সেতু বিভাগের একটি সূত্র জানায়, এটা আসলে ইতিবাচক কোনো বিষয় নয়। স্রেফ টাকা আটকে রাখার চেষ্টা। অর্থবছর শেষে টাকা ফেরত যাবে ভেবে ৩৭১ কোটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনগুলোকে। অথচ সংশ্লিষ্ট জমির মালিকরা এখন পর্যন্ত অধিগ্রহণের নোটিশ পর্যন্ত পাননি। এক কথায় অধিগ্রহণ হয়নি এক ইঞ্চি জমিও। যেভাবে কাজ চলছে তাতে ভাঙ্গা-কুয়াকাটা মহাসড়ক ফোর লেন হওয়া এখনো পুরোপুরি অনিশ্চিত।