সাতক্ষীরায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী আব্দুল হামিদ গ্রেফতার
রঘুনাথ খাঁ:
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রেফতারি পরোয়ানার আসামী ৭৯ বছর বয়সী আব্দুল হামিদ খানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।রোববার সন্ধ্যা ৭ টার দিকে কালিগঞ্জ উপজেলার পূর্ব নলতা এলাকার নিজ বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃত আব্দুল হামিদ খান সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার পূর্ব নলতা গ্রামের মৃত. নেছার আলী খানের ছেলে।
সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গ্রেফতারকৃত হামিদ খান আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ০১/২২ নং মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী। রোববার সন্ধ্যায় তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
প্রসঙ্গত, কালিগঞ্জের ইন্দ্রনগরের শেখ জবেদ আলীর ছেলে শেখ আকবর আলী দীর্ঘদিন ইন্দ্রনগর -হুসাইনাবাদ ছিদ্দিকিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বপালনকালে তার বিরুদ্ধে চরম অনিয়ম ও দূণীতির অভিযোগ ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অভিযোগে নিজেরই আত্মীয় দেবহাটার জগন্নাথপুরের রহমতুলাহ মোড়লকে ১৯৭১ সালে(৭ আশ্বিন , মঙ্গলবার) নলতা হাটে গুলি করে হত্যা করেন আকবর মাওলানা, পূর্ব নলতার আব্দুল হামিদ খান, ইন্দ্রনগরের মুনসুর পাড়সহ কয়েকজন।। প্রায় একই সময়ে আকবর মাওলানার নেতৃত্বে জগন্নাথপুর ঘোষপাড়ায় মাধব ঘোষ, তার বাবা, কাকাসহ চারজন ও পাশের বাড়িতে বেড়াতে আসা বৈকারীর সাবু মাষ্টারকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করেন আকবর আলী ও তার সহযোগীরা। লুটপাট করা হয় ওই সব বাড়িতে। কালিগঞ্জের ঈশ্বরদি গ্রামের আটা বিক্রেতা মাদার গাজীকে গুলি করে হত্য, পূর্ব নলতার খোকন মোড়লের বাবাকে গুলি করে তার হাত পঙ্গু করে দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে আকবর মাওলানা, অঅব্দুল হামিদ খান, মুনসুর পাড়সহ তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে।
সূত্রটি আরো জানায়, ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে আকবর মাওলানা আত্মগোপন করেন। এ সময় তিনি তার বেতন যথারীতি তুলেছেন। ২০১৩ সালে জামায়াত- বিএনপি’র সরকার বিরোধী নাশকতা চালানোর সময় আকবর মাওলানা আবারো প্রকাশ্যে আসেন। নাশকতা, হত্যা ও সরকারি বিরোধী কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগে আকবর মাওলানার বিরুদ্ধে ইন্দ্রনগরের সাংবাদিক আহাদ হোসেন বাদি হয়ে ১৭/১৪(কালিঃ), একই এলাকার আব্দুস সবুর বাদি হয়ে ১৮/১৪ ও সিরাজুল ইসলাম বাদি হয়ে ১৯/১৪ মামলা করে। এ ছাড়া আকবর মাওলানার বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৫০টি হত্যা, নাশকতা মামলা রয়েছে। আকবর মাওলনার বিরুদ্ধে জগন্নাথপুরের রহমতুলাহকে গুলি করে হত্যার দায়ের তার ছেলে গোলাম মোস্তফার যুদ্ধাপরাধী মামলা (০৭/১৯)দায়ের করেন।
দেবহাটা উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের মৃত রহমতুলাহ মোড়লের ছেলে গোলাম মোস্তফা জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার বাবা রহমতুলাহ মোড়ল নলতা হাটে গেলে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে তাকে(বাংলা ৭ আশ্বিন মঙ্গলবার) গুলি করে হত্যা করেন শেখ আকবর আলী, আব্দুল হামিদ খান, মুনসুর পাড়সহ কয়েকজন । সেখান থেকে খাটিয়ায় করে বাবার লাশ বাড়িতে আনেন তিনি। সুবিধাজনক পরিবেশ না পাওয়ায় দীর্ঘ ৩৮ বছর যন্ত্রণা সহ্য করে তিনি ২০০৯ সালে শেখ আকবর আলী, আব্দুল হামিদ খানসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা (জিআর -৯২/২০০৯ কালিঃ) দায়ের করেন। যাহা বর্তমানে আইসিটি(বিডি)০৭/১৯। বর্তমানে ওই মামলাটি আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ ১/২২ মামলা হিসেবে বিচারাধীন। বর্তমানে আকবর মাওলানা জামিরেন মুক্তি পেলেও আব্দুল হামিদ খান পলাতক ছিলেন।
গোলাম মোস্তফা আরো বলেন, আকবর আলীর বিরুদ্ধে মামলা করায় দেবহাটা উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার আব্দুল গণি খুশী হলেও পরবর্তীতে আকবর মাওলানার মেয়ের সঙ্গে আব্দুল গণির ছোট ছেলে কাইয়ুমের সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় তিনি মামলা তুলে নেওয়ার জন্য তাকে চাপ দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে কৌশলে সাতক্ষীরা কোর্টে ডেকে নিয়ে মামলা প্রত্যাহারের জন্য এফিডেফিটে সাক্ষর করতে বলায় তিনি পালিয়ে চলে আসেন। এ কারণে আব্দুল গণির সঙ্গে হাসনাবাদে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংএ গেলেও তার কাগজপত্র আর আলোর মুখ দেখতে দেননি আব্দুল গণি।
এদিকে সাতক্ষীরা আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর কলারোয়া উপজেলার ব্রজবক্স গ্রামের জামাতার বাড়ি থেকে শেখ আকবর আলীকে গ্রেপ্তার করে আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার সদস্যরা। জেলখানায়(হাজতী ৭৫৫/২১) স্পন্ডিলাইটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ২৭ জুলাই থেকে ওই বছরের ২২ আগষ্ট সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার কাগজপত্র দেখিয়ে ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর শেখ আকবর আলীর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্রুনালে জামিন আবেদন করেন(০১/২২) আইনজীবী অ্যাড. মুজাহিদুল ইসলাম। আকবর আলীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে বিচারপতি মোঃ শাহীনুর ইসলাম, বিচারপতি মোঃ আবু আহম্মেদ জমাদার ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল ইসলাম তাকে জামিন দেন। জামিনদার হিসেবে ভাইপো ঢাকা মীরপুরের মোঃ কা নের বাসায় থেকে অন্যত্র যাওয়া চলবে না, আসামী বা তাদের আত্মীয় স্বজন ইলেকট্রনিকস মিডিয়া বা প্রিন্ট মিডিয়ার সামনে কথা বলতে পারবে না, বাদি বা কোন সাক্ষীকে প্রভাবিত করতে পারবে না, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জামিনদারের সাথে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে হওয়া সহ জামিনে পাঁচটি শর্ত আরোপ করা হয়।
সূত্রটি আরো জানায়, ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর সকালে তারালী ব্রীজের পাশে রাস্তার উপর গুড়ি ফেলে ও নাশকতা সৃষ্টির অভিযোগে কালিগঞ্জের জাফরপুরের আনছার আলীর ছেলে আলমগীর হোসেন, আকবর আলী ও তার ছেলে মামুন বিলাহসহ ২৯জনের নাম উলেখ করে ওই দিনই থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে জিআর-২৯৯/১৩ মামলা করেন। বাবা ও ছেলেসহ ৩২ জনের নামে অভিযোগপত্র দাখিলের পর যাহা বর্তমানে সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-২ আদালতে বিচিারাধীন (এসটিসি-৬২/১৫)। ১৬ নভেম্বর জামিন পান আকবর আলী। ২০২০ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারি অভিযোগ গঠণের দিন অন্য মামলায় জেলে থাকায় সময়ের আবেদন জানালে আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। গত ১০ এপ্রিল অ্যাড. আশরাফুজ্জামান ও অ্যাড. মিজানুর রহমান পিন্টুর জামিন আবেদন শুনানীকালে বিরোধিতা করেন অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু। ওই দিন বিকেলে আকবর আলীর চিকিৎসার কাগজপত্র ও যুদ্ধাপরাধ মামলার জামিনের কাগজপত্র যাঁচাই করার পর তাকে আগামি ধার্য দিন ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ হাজার টাকা বণ্ডে অন্তবর্তীকালিন জামিন দেন বিচারক বিশ্বনাথ মণ্ডল।
অপরদিকে গত বছরের ১৫ ফেব্র“য়ারি কালিগঞ্জ থানার জিআর ৩৩০/১৩ ও টিআর-৪৮০/১৫ নং বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় জামিন পান শেখ আকবর আলী। গত ৩ এপ্রিল ওই মামলায় পিডব্লিউ লাগানো হয়। ১১ এপ্রিল তা প্রত্যাহারের পর জেল থেকে মুক্তি পান আকবর আলী। এরপর রবিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে অঅব্দুল হামিদ খানকে পুলিশ তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। তবে অপর আসামী মুনসুর পাড় দীর্ঘদিন সাতক্ষীরা সদরের মাগুরা তালতলা এলাকায় বসবাস করলেও গ্রেফতারি পরোয়ানার পর তিনি পালিয়ে যান।