কালিগঞ্জের রতনপুরে খাল দখলের অভিযোগ ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে : ঝুঁকিতে সরকারি রাস্তা ও প্রবাসীর বসতবাড়ি
এস কে ফিরোজ আহমেদ:
শত চেষ্টা করেও দখলদারদের দৌরাত্ম্য কমানো যাচ্ছে না কালীগঞ্জের রতনপুরে। নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান এম আলিম আল রাজি টোকন সম্প্রতি সকল দখলদারদের উচ্ছেদ পূর্বক সরকারি খাল অবমুক্ত করে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন। কিন্তু এবার সরকারি খাল দখল ও উপজেলা প্রশাসনের আইন অমান্য করার অভিযোগ উঠল তাঁরই পরিষদের এক ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে।
অভিযুক্তের নাম মোঃ সাইফুল ইসলাম গাজী। তিনি ১১ নং রতনপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের গড়ুইমহাল গ্রামের মৃত : মোকছেদুর গাজীর ছেলে এবং উক্ত ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য।
ভুক্তভোগী এক প্রবাসীর স্ত্রী প্রতিকার চেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম বাদিনীর বসতভিটা সীমানা বরাবর দীর্ঘদিন যাবত সরকারি খাল দখল করে ও প্রশাসনিক আইন অমান্য করে অ-পরিকল্পিতভাবে মৎস্য উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ফলে মৎস্য ঘেরের পানির প্রভাবে বাদিনীর বসতবাড়ির প্রাচীর ভেঙ্গে যায়।
প্রবাসী পরিবার নতুন প্রাচীর স্থাপন করাসহ অভিযুক্ত ইউপি সদস্যকে ভেড়িবাঁধের মাধ্যমে মাছ চাষের অনুরোধ করেন। কিন্তু ইউপি সদস্য কোন কথায় কর্ণপাত না করে তার মৎস্য ঘের পরিচালনা করছে। ফলে বাদিনীর প্রাচীর পুনরায় ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এ বিষয়ে প্রবাসীর স্ত্রী প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গড়ুইমহল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও গড়ুইমহল কমিউনিটি ক্লিনিকের পূর্ব পাশে প্রবাসী আব্দুর রহমানের একটি বসতঘর অবস্থিত। অন্যদিকে গড়ুইমহল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে চলাচলের একটি ইটের সলিং সড়ক রয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের পূর্বপাশে ও প্রবাসী আব্দুর রহমানের বসত-ঘরের সীমানা বরাবর এবং গড়ুইমহল স্কুলের সামনের ইটের সলিং রাস্তার সীমানা বরাবর ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলামের মৎস্য ঘের অবস্থিত।
ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলামের ঘেরের দক্ষিণ পাশের ভেড়ি হিসাবে ইটের সলিং রাস্তা এবং পশ্চিম পাশের ভেড়ি হিসাবে প্রবাসী আব্দুর রহমানের চলাচলের রাস্তা ও বসত-ঘরের প্রাচীর ব্যবহৃত হচ্ছে। ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলামের ঘেরের পূর্ব সীমানার পর হতে সরু একটা পানি নিষ্কাশনের ড্রেন লক্ষ্য করা যায়। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে কমিউনিটি ক্লিনিকের সীমানা হতে ইটের সলিং বরাবর পানি নিষ্কাশনের জন্য একটি প্রবহমান খাল ছিল। দখলদারদের দখল রাজত্বে সেটি এখন সরু ড্রেনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম খালটি সম্পূর্ণ দখল করেছেন,তার ঘেরের পাশে সরু ড্রেনও নেই।ফলে বর্ষার সময় স্কুলের মাঠ সহ কমিউনিটি ক্লিনিক পানির নিচে প্লাবিত হয়ে যায়।
আরও দেখা যায় যে, ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলামের ঘেরের কোন বেড়িবাঁধ ও আউট ড্রেন না থাকায় সরকারি রাস্তা ভেঙ্গে যাচ্ছে এবং প্রবাসী আব্দুর রহমানের চলাচলের রাস্তা অধিকাংশ ভেঙে গেছে ও বসত-ঘরের প্রাচীর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে উপজেলা প্রশাসন পুরো কালিগঞ্জ উপজেলায় মাইকিংয়ের মাধ্যমে জনসাধারণকে মৎস্য ঘেরের জন্য আইনি বিধিমালা প্রচার করেন। এতে জানানো হয় যে,”উপজেলা সংযোগ সড়ক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভেড়ি পার্শ্ববর্তী সকল পুকুর বা ঘেরের মালিকদেরকে রাস্তা/ভেরি সংলগ্ন নিজ ভূমির কমপক্ষে ১০ ফুট অভ্যন্তরে জলাশয় সীমাবদ্ধ অথবা আউট-ড্রেন নির্মাণ পূর্বক মৎস্য উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশনা দেয়া গেল। এই আদেশ অমান্য কারীর বিরুদ্ধে,
১ । দ্যা বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাটাক ১৯৫২ এর ৩ ধারায় বিধান লঙ্ঘন করিলে এই আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী দোষী ব্যক্তিকে আদালত ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করিতে পারিবে।
২ । ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২৮ এবং ১৯৫২ দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ৪৩১ অনুযায়ী “সরকারি রাস্তার ক্ষতি দণ্ডনীয় অপরাধ” এই আইনে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এছাড়াও ক্রান্ত আইনের ধারা ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায় উপজেলা প্রশাসনের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একজন সদস্য হয়েও ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম উল্লেখিত কোন আইনই মানছেন না।
তিনি সরকারি খাল দখল করে মৎস্য ঘের পরিচালনা করার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করাসহ উপজেলা প্রশাসনের আইন অমান্য করে সরকারি রাস্তার ক্ষতি করা এবং প্রতিবেশীর চলাচলের রাস্তা ও বসত ঘরের ক্ষতিসাধন করে প্রতিবেশীর “সুখাধিকার” আইন লঙ্ঘন করছেন বলে মনে করেন সুশীলরা।
এবিষয়ে ভুক্তভোগী প্রবাসীর স্ত্রী বলেন,”আমার স্বামী সৌদি আরবে থাকেন। আমি ও আমার স্কুলপড়ুয়া মেয়ে এখানে বসবাস করি। সাইফুল মেম্বারের ঘেরের পানিতে আমাদের প্রাচীর ভেঙে গিয়েছিল, আমরা পুনরায় প্রাচীর নির্মাণ করেছি এবং তাকে অনুরোধ করেছি বেড়িবাঁধ দিয়ে ঘের করার জন্য। কিন্তু তিনি আমাকে হুমকি দিয়ে বলেন, আমি এভাবেই ঘের করব পারলে আমার নামে কেস কর। তাই আমি বাধ্য হয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট অভিযোগ দিয়েছি। আমার স্বামী বাড়িতে না থাকায় আমারা খুব অসহায়ত্ব বোধ করছি। আমি চাই প্রশাসন দ্রুত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক এবং আসন্ন ক্ষতির হাত থেকে আমাদের রক্ষা করুক।”
এলাকার একাধিক ব্যক্তি বলেন,”সাইফুল মেম্বার অদৃশ্য ক্ষমতাবলে প্রবহমান সরকারি খাল দখল করে মাছ চাষ করছে। ফলে বর্ষার সময় স্কুল, কমিউনিটি ক্লিনিক ও এলাকার একাধিক বসতঘর পানিতে ডুবে যায়, পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া উপজেলার নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কোন প্রকার ভেড়িবাঁধ ও আউট ড্রেন ছাড়া ঘের করে আসছে।
এতে রাস্তা ভেঙে তার ঘেরে পতিত হচ্ছে। আমাদের চলাচলের ইটের রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়াও তার অপরিকল্পিত মৎস্য ঘেরের কারণে প্রবাসী আব্দুর রহমানের বসতবাড়ি ঝুঁকিতে রয়েছে। আমরা চাই সরকার অন্য খালগুলোর মত আমাদের খালটিও মেম্বারের নিকট থেকে দখল মুক্ত করুক এবং সঠিক নিয়মে বেড়িবাঁধের মাধ্যমে সকলকে ঘের করতে বাধ্য করুক, যাতে আমাদের রাস্তার কোনো ক্ষতি না হয়।
এ সম্পর্কে সরকারি খাল দখল করার বিষয় স্বীকার করে অভিযুক্ত মেম্বর সাইফুল ইসলাম বলেন,”সরকারি খাল আমি ছাড়াও আরও অনেকেই খাচ্ছে এবং আমার ঘের ছাড়াও আরো অনেকের ঘের বা পুকুরের কারণে রাস্তার ইট নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু শুধু আমারটাই কেন নজরে আসছে ? আগামী বছরে ঘের শুকিয়ে নিয়ম অনুযায়ী ভেড়িবাঁধ দিব। আর প্রবাসী রহমান সাহেবের পাঁচিল একেবারে সীমানা বরাবর নির্মাণ হয়েছে, পাশে সে কোন জায়গা রাখেনি। এজন্য আমিও আমার সীমানায় কোন ভেড়িবাঁধ দিব না।”
এ বিষয়ে রতনপুর ইউপি চেয়ারম্যান আলিম আল রাজি টোকন বলেন,”সরকারি খাল দখলমুক্ত করণে আমি বদ্ধপরিকর। ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম যদি সরকারি খাল দখল করে থাকেন তাহলে আমি দ্রুত সেটিকে উন্মুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করব। তাছাড়া একজন মহিলা তার বিরুদ্ধে ইউএনও অফিসে অভিযোগ করেছেন, যেটি ইউএনও মহোদয় আমার উপর দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি দ্রুত এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”
বিষয়টি সম্পর্কে উপজেলা নির্বাহী অফিসার খন্দকার রবিউল ইসলাম বলেন,খাল দখলের বিষয়টি আমার জানানেই আমি খোঁজ নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।