নারী শিক্ষকের হাজার কোটি টাকার সম্পদ, চেয়ারম্যান স্বামীর পুকুরচুরি
নিউজ ডেস্ক:
কুষ্টিয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষকের শত কোটি টাকার সম্পদের উৎসের সন্ধানে নেমে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে দুদকের সম্প্রসারিত তদন্তের জালে আটকে গেছেন ওই স্কুল শিক্ষকের স্বামী কুষ্টিয়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা।
দুদক সদর দফতর থেকে পাঠানো নির্দেশনায় এখন আর কেবলমাত্র ৪নং পৌর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাম্মী আরা পারভীনের জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদই নয়, সমন্বিত তদন্ত প্রক্রিয়ায় তার স্বামীর অবৈধ সম্পদের হদিস উদঘাটনে নেমেছে দুদক। সে লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের কুষ্টিয়া সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক জাকারিয়া স্বাক্ষরিত একটি ইনকোয়ারি পত্র সরকারের সব দফতরে পাঠিয়ে ১৩ এপ্রিলের মধ্যে সকল তথ্য দিতে অনুরোধ করেছিলেন।
দুদক কুষ্টিয়া কার্যালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে, সব তথ্যই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারি দফতরগুলো থেকে পাঠানো হয়েছে। এখন সেগুলো যাচাই-বাছাই শেষে সঠিক তথ্যের মানদণ্ড ধরে মামলা চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
এদিকে অভিযোগ নাকচ করেছেন সহকারী শিক্ষক শাম্মী আরা পারভীন এবং তার স্বামী আতাউর রহমান আতা। তারা বলছেন, একটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতেই পরিকল্পিতভাবে এসব অভিযোগ দাঁড় করিয়েছে। জ্ঞাত আয় বহির্ভুত বা অপ্রদর্শিত কোনো সম্পদই তাদের নেই। দুদক মামলা করলে তারা মোকাবিলা করবেন বলেও জানান এ দম্পতি।
গত বছরের মধ্যবর্তী সময় সদর দফতরে একটি অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক জানতে পারে- কুষ্টিয়া শহরের ৪নং পৌর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাম্মী আরা পারভীনের বিভিন্ন ব্যাংকে চলমান নানা ধরনের সঞ্চয়ী স্কিম হিসাবে প্রায় অর্ধশত কোটি নগদ টাকা ছাড়াও উচ্চমূল্যের জায়গা-জমি, ভবন, মার্কেটসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির একত্রে আনুমানিক মূল্যমান শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
একজন স্কুলশিক্ষকের ব্যাংক হিসাবে একসঙ্গে জমাকৃত এত টাকার উৎসের সন্ধান শুরু করে দুদক। এ সময় শাম্মী আরা পারভিনের অধিকাংশ ব্যাংক হিসাবের ট্রানজেকশনের সূত্র সন্ধানে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতার নাম উঠে আসে। সঙ্গত কারণেই এটি হয়ে ওঠে দুদক তদন্তের টার্নিং পয়েন্ট। যে কারণে গত বছরের মধ্যবর্তী সময়ে শুধুমাত্র শাম্মী আরা পারভিনের মামলাটি ছাড়াও মুখ্য হয়ে ওঠে তার স্বামী আতাউর রহমান আতার সম্পদের অনুসন্ধান। তাই ট্যাগিং সিস্টেমে স্বামী স্ত্রী দুজনের মামলা একত্রে প্রক্রিয়াধীন।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শহিদুর রহমান জানান, ২০১৯ সালের এপ্রিলে বিনাপ্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত কুষ্টিয়া সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা তার প্রার্থীতাপত্রে সংযুক্ত অঙ্গীকারনামায় স্ত্রী ও নিজ নামীয়/স্বত্ত্বাধীন স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির বিবরণে যথাক্রমে ১৫ লাখ ও ৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকার ব্যাংক হিসাব এবং সম্পদের উল্লেখসহ সরকারি কোনো লাভজনক উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদার নন বলে অঙ্গীকার করেন।
দুদকের নোটিশ সূত্র আরো জানায়, চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা ও তার স্ত্রী শাম্মি আরা পারভীনকে চলতি মাসের ১৩ তারিখের মধ্যে দুদকের নির্দিষ্ট ছকে সব সম্পত্তির হিসাব দাখিল করতে বলা হয়েছিল।
দুদকের সমন্বিত কুষ্টিয়া জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. জাকারিয়া জানান, আতাউর রহমান আতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বালুমহাল ব্যবসা, হাট-বাজার ইজারা, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা খাত থেকে অর্জিত অবৈধ সম্পদের হিসাবে এক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। একইভাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাম্মী আরা পারভীন তার স্বামীর রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে অবৈধ পন্থায় অর্জিত শতকোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ আছে। এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের তথ্য জানাতে বিভিন্ন সরকারি দফতরে গত ৩০ মার্চ পত্র পাঠানো হয়েছিল।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী মুন্সি মো. মনিরুজ্জামান, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুর রহমান মন্ডল, সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাকিরুল ইসলাম, গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম, শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইসতিয়াক ইকবাল হিমেল।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত এক ভুয়া মামলাবাজের খপ্পরে আটকে কেবলমাত্র জেলার ২১টি বালুমহাল থেকে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আয় করেছেন প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা। যা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ভেড়ামাড়া উপজেলার ষোল দাগ গ্রামের বাড়ি থেকে ২০১২ সালে কুষ্টিয়া শহরের মজমপুরের একটি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন আতাউর রহমান। সর্বশেষ ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
অভিযোগ আছে, মাধ্যমিক উত্তীর্ণ এ নেতা ম্যানেজিং কমিটিতে নানা জটিলতা সৃষ্টি করে স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ছাড়াও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য করে শতকোটি টাকা হাতিয়েছেন। এছাড়া কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণে পুকুরচুরি জেলাজুড়ে আলোচিত বিষয়।