ভুয়া বিজ্ঞাপন দিয়ে ১৭০ কোটি টাকা লোপাট

অনলাইন ডেস্ক: ‘ফোসান গ্রুপ’ নামে এক নামসর্বস্ব কোম্পানির চেয়ারম্যান জিয়াউদ্দীন জামান প্রতারণার মাধ্যমে শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৭০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিদেশে নামি কোম্পানি আর ব্যবসার ভুয়া বিজ্ঞাপন দেখিয়ে তিনি এসব টাকা হাতিয়ে নেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে তিনি প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ঋণও নিয়েছেন। আবার এ টাকার উল্লেখযোগ্য অংশ তিনি বিদেশে পাচারও করেছেন। সোমবার ঢাকার উত্তরা থেকে প্রতারক জিয়াউদ্দীনকে গ্রেফতারের পর মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে তার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে র‌্যাব।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, জিয়াউদ্দীনের ঢাকার অফিসটি খুবই সুসজ্জিত। তিনি হাতে পরতেন রোল্যাক্স ঘড়ি, চড়তেন ল্যান্ডক্রুজারে। ফোসান গ্রুপের টাইলস ও স্যানিটারি পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে টাকা বিনিয়োগ করতে বলতেন। এভাবে তিনি মার্কেট থেকে অন্তত ১৭০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে র‌্যাবের কাছে তথ্য রয়েছে। এসব টাকা দিয়ে তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ১৩০ বিঘার মতো জমি কিনেছেন। জমির বিপরীতে আবার ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকার মতো ঋণ নিয়ে রেখেছেন।

কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জিয়াউদ্দীনকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, তাদের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অর্থ আত্মসাতের পর উলটো পাওনাদারদের ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করেন জিয়াউদ্দীন। তার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে। গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের ৩৭টি চেক বই, ছয় বোতল বিদেশি মদ, ৯৯ হাজার টাকার জালনোট, ৬ হাজার ডলারের জাল নোট, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ‘জাপানে তৈরি’ স্টিকার, পাঁচ ধরনের আইডি ও বিজনেস কার্ড, নগদ ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা এবং ‘২০০ কোটি টাকা নেওয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সংক্রান্ত নথিপত্র’ জব্দের কথা জানিয়েছে র‌্যাব।

র‌্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, জিয়াউদ্দীন নিজেকে ১২টি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, চেয়ারম্যান বা এমডি বলে দাবি করতেন। অস্ট্রেলিয়া, চীন, হংকং, ওমান ও দুবাইয়ে তার বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে প্রচার করে অনেককে ‘ব্যবসায়িক পার্টনার’ বানাতে চাইতেন। এভাবে তিনি শতাধিক ব্যক্তিকে প্রলুব্ধ করে বিপুল টাকা হাতিয়েছেন। জিয়াউদ্দীনকে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্ধৃতি দিয়ে র‌্যাব জানায়, ২০১৪ সালে ফোসান সিরামিক লিমিটেড স্যানিটারি প্যাড, হাইলেডি স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ বিভিন্ন পণ্যের আকর্ষণীয় টিভিসি বানান তিনি। এর মাধ্যমে ব্যবসায়িক অংশীদার বানানোর লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে টাকা ওঠানো শুরু করেন। কেবল ভুয়া বিজ্ঞাপন আর ভুয়া কোম্পানির ওয়েবসাইট বানিয়েই ক্ষান্ত হননি, সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের বিদেশে নিয়ে সাজানো-গোছানো ফ্যাক্টরিতে ঘুরিয়েও এনেছেন জিয়াউদ্দীন। সেসব কারখানা নিজের বলেই তিনি প্রচার করতেন। মঈন বলেন, ওই সব ফ্যাক্টরির অফিস পরিদর্শনের জন্য তিনি সেখানে আগে থেকেই লোক ‘ফিটিং’ করে রাখতেন। এজন্য অর্থও খরচ করতে হতো। সাজানো-গোছানো অত্যাধুনিক ফ্যাক্টরি দেখিয়ে বাংলাদেশেও তিনি এ ধরনের ফ্যাক্টরি বানানোর কথা বলতেন। দেশে উৎপাদিত পণ্যের অস্বাভাবিক লাভ দেখিয়ে লোভের ফাঁদে ফেলতে রীতিমতো সিদ্ধহস্ত জিয়াউদ্দীন। এভাবে দেশি/বিদেশি ব্যবসায়ীসহ খ্যাতনামা অনেককেই প্রলুব্ধ করতে পেরেছিলেন।

প্রতারণার কৌশল হিসাবে জিয়াউদ্দীন ব্যবসায়ীদের দামি এবং আকর্ষণীয় উপহার পাঠাতেন জানিয়ে খন্দকার মঈন বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তার খাতির রয়েছে বলে প্রচার করতেন। প্রজেক্টের নামে কয়েকশ একর জমি লিজ নিয়ে সেটিকে তার নিজস্ব সম্পত্তি হিসাবে দেখাতেন সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের। তা দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছেন। ভুয়া কৃষি খামার ইত্যাদিতে আকৃষ্ট হয়ে ব্যবসায়ীরা তার হাতে টাকা তুলে দিতেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০০৯ সালে প্রবাসে থাকা অবস্থায় টাইলস ব্যবসার খুঁটিনাটি সম্পর্কে ধারণা পান জিয়াউদ্দীন। এ ছাড়া বিদেশি দুটি দেশের মাফিয়াদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তর করেন। এভাবে অর্থ পাচার চক্রের সঙ্গে তার সখ্য তৈরি হয়। ২০১৪ সাল থেকে ফোসান সিরামিক লিমিটেড, হাইটেক সিরামিক লিমিটেডের নামে পণ্য আমদানির সময় অধিক মূল্য দেখিয়ে তিনি বিদেশে অর্থ পাচার শুরু করেন। ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত অর্ধশত কোটি টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া যায়।

মঈন বলেন, নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশে ফোসান সিরামিকের লোগো খোদাই করে পণ্যগুলো নিজের ফ্যাক্টরির তৈরি বলে সবাইকে দেখাতেন জিয়াউদ্দীন। নিজেকে একজন ‘আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী’ বলে প্রচার করতেন। প্রতারণার মাধ্যমে পাওয়া টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। চারটি ব্রান্ডের সিরামিকস বা টয়লেট ডেকোরেশন আমদানিতে ২৪ থেকে ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে তিনি টাকা পাচার করতেন। অতিরিক্ত মূল্যের ৬ শতাংশ বিদেশি কোম্পানি এবং বাকি অংশ তিনি নিতেন। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে জিয়াউদ্দীনের ৩৯টি অ্যাকাউন্ট ও বিদেশে তিনটি ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)