আজ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব দোলযাত্রা
আঃজলিল:
গত প্রায় দুই বছর মহামারী করোনার সুপার সাইক্লোনে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ স্থবির হয়ে পড়েছিল।ফলে যেকোন সামাজিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ছিল না কোন রং।কিন্তু করোনার সংক্রমণ ফিকে হয়ে যাওয়ায় এবার সকল সামাজিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় উৎসবে নানা রকম উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। আর তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বার মাসের তের পার্বনের একটি দোলযাত্রায় লেগেছে রঙের হাওয়া।
শীতের আগমনীতে পৃথিবীর সমগ্র প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানব হৃদয়ে দেখা যায় নানা পরিবর্তন।
কিন্তু শীতের বিদায়ে ও বসন্তের আগমনে মানুষের হৃদয়ে যেমন পরিবর্তন সাধিত হয়। তেমনি গাছপালাও তার পুরাতন শাখা পল্লব ঝেড়ে ফেলে নতুন কচিপাতা ভরে যায় এবং পলাশ, শিমুল,কৃষ্ণচূড়াসহ রঙবেরঙের নানা ফুলের সমাহার দেখা যায়।
প্রকৃতির এই আনন্দঘন মুহুর্তে ফাগুনের বনে আগুন লাগিয়ে মানুষের হৃদয়কে ভালবাসার রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য আর্বিভূত হয় সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও বর্ণিল উত্সব দোল পূর্ণিমা বা দোল যাত্রা। বাংলা ও ওড়িষা ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন স্থানসহ সমগ্র পৃথিবীর যেখানেই সনাতন ধর্মাবলম্বী আছেন সেখানেই এই দোল উত্সব মহাসমারোহে পালিত হয়।
দেশের অন্যান্য স্থানে, বিশেষ করে উত্তর ভারতে দোল যাত্রা হোলি নামে পরিচিত। তবে দুটি জিনিস এক হলেও এর পেছনে রয়েছে অন্য কারণ। দোল উত্সবের অপর নাম হল বসন্তোত্সব। যা ভারতের শান্তিনিকেতনে সুবিখ্যাত। ফাল্গুন মাসের পূ্র্ণিমার পূর্ণ তিথিতে প্রতিবছর দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন হিন্দু ঐতিহ্যেই হোলি উৎসবের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য রয়েছে। এটি একটি উৎসবমুখর দিন যখন একজন অপর জনের অতীতের ভুলক্রটি গুলো ভুলে যায়। একে অপরের মধ্যকার ঝগড়া-বিবাদ মিটমাট করে ফেলে এবং সকল অপরাধ ক্ষমা করে দেয়। হোলি উৎসব একই সাথে বসন্তের আগমন বার্তাও নিয়ে আসে। অনেকের কাছে এটা নতুন বছরের শুরুকে নির্দেশ করে। এটি মানুষের জন্য ঋতু পরিবর্তনকে উপভোগ করা ও নতুন বন্ধু বানাবার উৎসব।
দোল পূর্ণিমার দিন পূর্ণ অবতার শ্রী কৃষ্ণ ও রাধা রানীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পূজা শেষে দোল নিয়ে ভক্তদের বাড়ি বাড়ি নিয়ে নাচানো হয়। এছাড়া দোল পূর্ণিমা বা দোলযাত্রার দিন ছোট- বড় সবাই রঙের উৎসবে মেতে ওঠে এবং রঙ খেলার পর মিষ্টি মুখ করে এই আনন্দের সমাপ্তি ঘটে। বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে হোলি উৎসব পালন হয়। তাই নয় দেশের বাইরে বিদেশিদের মধ্যেও এর প্রচলন দেখা যায়। দোল পূর্ণিমা দিন হোলির রঙে সবাই নিজেদের রাঙ্গিয়ে তোলে, সমস্ত বিভেদ ভুলে এক হয়ে যায়। দোল বা হোলির অর্থ এক হলেও দুটি ভিন্ন অনুষ্ঠান। দোল ও হোলি কখনওই এক দিনে পড়ে না। দোল যাত্রা বা বসন্তোত্সব একান্তই বাঙালিদের রঙিন উত্সব। আর হোলি হল অবাঙালিদের উৎসব। বাঙালিদের মধ্যে দোলযাত্রাকে বসন্তের আগমনী বার্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বৈষ্ণবদের মতে, দোল পূর্ণিমার দিন শ্রীকৃষ্ণ আবির নিয়ে শ্রীরাধা ও সঙ্গীয় গোপীদের সঙ্গে রঙ খেলায় মত্ত ছিলেন। সেখান থেকেই দোলযাত্রার শুরু। ১৪৮৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, দোল পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মগ্রহণকে কেন্দ্র করেও এই মহোত্সব পালন করা হয়। এই তিথিকে গৌর পূর্ণিমাও বলা হয়। তবে শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর সঙ্গী এবং গোপীদের সঙ্গে রঙ খেলার অনুষ্ঠানই এই দোলযাত্রার মূল কেন্দ্রবিন্দু। শ্রীকৃষ্ণের লীলা কবে থেকে শুরু হয়েছিল, তা জানা না গেলেও বিভিন্ন পুরাণ ও গ্রন্থে সেই মধুর ও রঙিন কাহিনীর উল্লেখ রয়েছে।
এছাড়া হিন্দু পুরাণে প্রায় ২ হাজার বছর আগে, ইন্দ্রদ্যুম্নের দ্বারা গোকুলে হোলি খেলা প্রচলনের উল্লেখ রয়েছে। তবে ইতিহাস বলছে প্রাচীন ভারতে ইন্দ্রদ্যুম্নের নাম একাধিকবার রয়েছে। তাই এই ইন্দ্রদ্যুম্ন আদতে কে ছিলেন, সেই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
আবার বসন্ত পূর্ণিমার দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, কেশি নামে একজন অসুরকে বধ করেন। কেশি একজন অত্যাচারী এবং নিষ্ঠুর অসুর ছিলেন। এর জন্য এই অত্যাচারী অসুর দমন হওয়ার জন্য এবং অন্যায় শক্তি ধ্বংস হওয়ায় আনন্দ উৎসবে এই দিনটি উদযাপিত হয়ে থাকে।
রাক্ষসকূলে জন্মগ্রহন করলেও প্রহ্লাদ ছিলেন খুবই ধার্মীক ও বিষ্ণুর ভক্ত। ফলে তাকে হত্যা করা সহজ ছিল না এবং কোনোভাবেই তাকে হত্যা করা যাচ্ছিল না। তখন হিরণ্যকশিপুর তার ছেলেকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেন। হিরণ্যকশিপুরের বোন হোলিকা বর পেয়েছিলেন আগুনে কোন দিন ক্ষতি হবে না। তাই প্রহ্লাদকে হত্যা করার জন্য হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেন। কিন্তু হোলিকা বর পাওয়া সত্ত্বেও সেদিন শেষ রক্ষা হয়নি। আগুনে পুড়ে হোলিকা মারা যায় এবং প্রহ্লাদ ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদে বেঁচে যায়। কিন্তু আগুনে ভস্ম হয়ে যায় হোলিকা। সেই দিনটি থেকে পালন করা হয় হোলি বা দোল উৎসব। হোলিকার এই কাহিনি চাঁচর বা হোলিকা দহন নামে পরিচিত, যা দোলের আগের দিন পালন করা হয়। অথবা যা সাধারণত নেড়াপোড়া বলে অভিহিত। নেড়াপোড়া দিন শুকনো ডালপালা, গাছের শুকনো পাতা দিয়ে বুড়ির ঘর করা হয়। এবং হোলিকার উদ্দেশ্যে সেই ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হোলিকা দহন পালন করা হয়।আবার অনেক হোলিকার উদ্দেশ্যে মাটির পুতুল বানিয়ে ওই শুকনো ডালপালার ঘরে রেখে জ্বালিয়ে দেয়। ওই দিনটি মানুষ নানা ভাবে পালন করে থাকে। এবং পরের দিন হয় দোল উৎসব।
১৭ মার্চ রাত ১ঃ২৯ মিনিট থেকে ১৮ মার্চ বরাত ১২ঃ৪৬ মিনিট পর্যন্ত পূর্ণিমা থাকবে।এই বছর দোলযাত্রা পড়েছে ১৮ মার্চ (বাংলায় ৩ চৈত্র)। এই দিনটিকে বসন্ত উৎসবও বলা হয়। হোলি সাধারণত দোলের পরের দিন পালিত হয়। তবে এবছর হোলি পড়েছে ১৯ মার্চ।
Please follow and like us: