কালিগঞ্জে ভাই ও মায়ের কারসাজি,পুলিশের খাতায় ১৩ বছরের নাবালিকা,কাজীর খাতায় ২০ বছরের সাবালিকা
নিজস্ব প্রতিনিধি :
কালিগঞ্জ উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের তেঘরিয়া গ্রামের মোঃ নুরুজ্জামাল গাজী (বাবু) এর অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া কন্যা নাজমুন নাহার সাথীর একই উপজেলার ধলবাড়িয়া ইউনিয়নের উচ্ছেপাড়া গ্রামের মোঃ শামসুর রহমানের ছেলে ইব্রাহিমের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বপ্নের ঘর বাধতে পালিয়ে যায় এই প্রেমিক প্রেমিকা।
সার্থক এই প্রেমিক যুগলের স্বপ্নের জগতে ভিলেন চরিত্রে আবির্ভাব ঘটে সাথীর মা নুরনাহার বেগমের। দেশের চলমান আইনে নুরনাহার বেগম গত ইং ০২-০৪-২০২১ তারিখ কালিগঞ্জ থানায় ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে তার ১৩ বছরের নাবালিকা মেয়েকে অপহরণের মামলা দায়ের করেন। শুরু হয় পুলিশের তৎপরতা। পুলিশ বাগেরহাট থেকে ভিকটিম সাথীকে উদ্ধারসহ আসামীদের গ্রেপ্তার-পূর্বক আদালতে প্রেরণ করেন। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্ত হয়ে ইব্রাহিমের, ভালোবাসার অপর পিঠটাও উপলব্ধি করা হয়ে গেল।
ইব্রাহিম দেশের চলমান আইনের প্রতি সম্মান রেখে ভাবলো,সাথীর বয়স ১৮ বছর হলে দুই পরিবারের সম্মতিতেই তারা এক হবে। কিন্তু বিধি বাম, সাথীর পরিবারের কাছে সবই সম্ভব। দেশের আইন যেন তাদের হাতেই পরিবর্তিত হয়।মাত্র ৭ মাসের ব্যবধানে ১৩ বছরের নাবালিকা সাথী হয়ে গেল ২০ বছরের সাবালিকা। সাথী এখন অন্যের ঘরের রমণী।
ইব্রাহিম ভাবতে ভাবতে পাগল প্রায়, একোন দেশে আছে সে, যে দেশের আইনের বয়স-সীমার বেড়াজালে তার স্বপ্নের ভালোবাসার ঘর বাঁধা হলনা, অন্যদিকে সেই দেশেরই কিছু অসাধু ব্যক্তিদের যোগসাজশে তার স্বপ্নের কন্যা আজ অন্যের ঘরণী। কার কাছে জানাবে অভিযোগ, কোথায় পাবে বিচার। উন্মাদ ইব্রাহিম ছুটে যান সাথীর মা নুর নাহার বেগমের নিকট। প্রশ্ন করে,”কি হবে আমার স্বপ্নের,কি হবে আমার হয়রানি মূলক অপহরণ মামলার।”নুর নাহার বেগমের সহজ উত্তর,”এক লক্ষ টাকা দিলে মামলা উঠিয়ে নিব”। কোন উপায় না পেয়ে ইব্রাহিম সংবাদ মাধ্যমের দ্বারস্থ হয়।
সত্যতা যাচাই করতে যেয়ে দেখা যায়,গত ইং ০২-০৪-২০২১ তারিখে সাথীর মা (নুরনাহার বেগম) কালীগঞ্জ থানায় তার কন্যার বয়স ১৩ বছর দেখিয়ে, ইব্রাহিম সহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে তার কন্যার অপহরণের মামলা করেন। কিন্তু মাত্র ৭ মাসের ব্যবধানে সাথীর জন্ম তারিখ ০৩-০৫-২০০১ অনুযায়ী বয়স ২০ বছর দেখিয়ে দেবহাটা উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের মোঃ মহিদ গাজীর পুত্র মোঃ রাকিব হোসেনের সাথে বিবাহ প্রদান করেন। কিন্তু সাথীর প্রকৃত জন্ম-নিবন্ধন অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ৩১-১২-২০০৭।
এবিষয়ে মেয়ের শ্বশুর মহিদ গাজী বলেন,বিয়ের আগে এসব কিছু জানতাম না,পরে সব শুনেছি অল্প বয়সে এসব একটু হতে পারে। মেয়েটি এখন আমাদের ঘরের বৌ, আপনি এসব বিষয়ে আর কিছু করেন না ভাই, ভুল সবার হয় বাদ দেন এবিষয় টা।
তবে সাথীর পরিবার,কাজী উপজেলার দেয়া গ্রামের মৃত মান্দার গাজীর পুত্র মাওলানা মোঃ করিম গাজী ও উপজেলার মৌতলা গ্রামের বিবাহ রেজিস্টার মোঃ আনোয়ারুল সাহাদাত সহ পরস্পরের যোগসাজশে ২১-১১-২০২১ তারিখ (বই নং -১৬০০,ভলিউম নং-৩৬, পৃষ্ঠা নং-৩৭) বিবাহ রেজিস্টার বইতে রাকিব ও সাথীর বিবাহ রেজিস্ট্রি করা হয়।
ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে রেজিস্টার মোঃ আনোয়ারুল সাহাদাত বলেন,” আমি বাল্য বিয়ে রেজিস্ট্রি করি না। করিম আমার সীল সই নকল করে এইটা করতে পারে। আর আমি এখন বই দেখাতে পারব না।”
এবিষয়ে জানতে চাইলে মাও: মোঃ করিম বলেন,”আমি অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে শুধু বিয়ে পড়াই। জন্ম নিবন্ধন অনেক সময় দেখা হয় না। অনেক আগে দু’একটা বাল্য বিয়ে পড়ানো হয়েছে। আর বাল্য বিয়ে পড়াবো না।
সাথীর বিবাহ রেজিস্ট্রির সম্পর্কে তিনি বলেন,”আমি মৌতলার সাহাদাত ভাইয়ের কাছে তাদের নিয়ে গিয়ে ছিলাম, কিভাবে রেজিস্ট্রি করেছেন সেটা তিনিই জানেন। আমি সবজায়গাতেই বলতে পারব, আমি জানি ঐ বিয়ের রেজিস্ট্রি সাহাদাত ভায়ই করেছেন।
ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলে সাথীর মা (নুর নাহার বেগম) বলেন,”অনেক খরচাপাতি করে মেয়ে বিয়ে দিছি। কমপক্ষে আমার খরচের অর্ধেক টাকা না দিলে আমি মামলা মিটাবো না। আমি অনেক কষ্টে আমার ছোট মেয়েটাকে বিয়ে দিছি।”
এই প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নুর নাহার বেগমের এক প্রতিবেশী বলেন,”ইব্রাহিম কয়েক বছর যাবত তাদের বাড়িতে প্রায়ই অবাধে আশা-যাওয়া করত।এটা এলাকার সকলেই জানেন। তারা প্রেম করে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। নুর নাহার বেগম মামলা করে,এখন শুনছি তাদের কাছে টাকা চাচ্ছেন। এটা অন্যায়। এর আগেও নুর নাহার বেগম নিজে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে। তাছাড়া মেয়েকে অন্য জায়গায় বাল্য বিয়ে দিয়েছে। এটার বিচার হওয়া দরকার।
এবিষয়ে ইব্রাহিম বলেন,”এই ঘটনাটি আমার জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে দেশের আইন অনুযায়ী এদের শাস্তি চাই। সেই সাথে আমি তাদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারব না,ফলে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা হয়রানি মূলক মামলা হতে রেহাই চাই।”
এদিকে স্থানীয় এক সালিশে সাথীর ভাই সবুজ গাজী মামলা মিটানোর জন্য ইব্রাহিমের পরিবারের কাছে ষাট হাজার টাকা দাবি করেন বলে জানিয়েছেন এম.ইকরাম শুভ। শুভ আরো বলেন, এই বিষয়ে এভাবে এই টাকা দাবি করাটা অমানবিক বলে মনে করি।
স্থানীয় সালিশে মামলা মিটানোর জন্য ইব্রাহিমের পরিবারের কাছে টাকা দাবি করার বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়ের ভাই সবুজ গাজী এই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আমার বোনের বিয়ে দিয়েছি, কেউ যদি বিরক্ত করে বা আমার বোনের কোন সমস্যা হয় তা হলে দুই তিনটা খুন করতে হলে আমি করব। আমার নামে অনেক মামলা আছে ,আমি কোর্ট সম্পর্কে জানি। আমি এখন থানায় যাচ্ছি জুব্বার সাংবাদিকরে নিয়ে,যদি কোটি টাকা ঢালতে হয় মামলা করতে, আমি তাই করব। এই বলে ফোনটি কেটে দেন তিনি।
অন্যদিকে মেয়ের ছোট মামা পরিচয় দানকারী কালিগঞ্জ উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের আশরাফ মাস্টারের ছেলে ছোটন এই প্রতিবেদককে ফোন করে বলেন, ভাই আপনি নিউজ করেন না। আমাদের ২০ হাজার টাকা দিলে আমরা ওই ছেলের নামের মামলা টা তুলে নিব।
এবিষয়ে কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খন্দকার রবিউল ইসলাম বলেন,যদিও তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে,তার পরেও আমাদের কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নিব।
এদিকে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধের দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য এই ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত পূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবী জানান সমাজের সচেতন মহল।