কল রেকর্ড ফাঁস কীভাবে হচ্ছে, কারা করছে
অনলাইন ডেস্ক :
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির টেলিফোনে কথোপকথনের রেকর্ড ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। ফাঁস হওয়া রেকর্ড বিশ্নেষণে দেখা যায়, দীর্ঘ আলাপের খণ্ডিত অংশ স্পষ্টত উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করা হচ্ছে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যখন যাদের আলাপ ফাঁস হচ্ছে, তা থেকেও জনমনে ধারণা জন্মেছে যে রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ ও প্রতিহিংসার কারণে এটা করা হচ্ছে। সাধারণ নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সাংবিধানিক অধিকার চরম হুমকির মুখে পড়লেও এসব কল রেকর্ড কীভাবে করা হচ্ছে, কোথায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে এবং কারা প্রচার করছে- তার সদুত্তর কখনও পাওয়া যায়নি।
সর্বশেষ আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের একটি ফোনালাপ সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর এ বিষয়ে প্রথম তদন্তের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, একটি ইনোসেন্ট কনভারসেশনকে (নির্দোষ বাক্যালাপ) পুঁজি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি মনে করেন, অবশ্যই এর তদন্ত হবে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল মঙ্গলবার সমকালকে বলেন, যেসব কল রেকর্ড ফাঁস হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এখন স্মার্টফোনে কল রেকর্ডের অপশন আছে, যে কারণে যে কেউ কল রেকর্ড করতে পারে। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা এর অধীন কোনো সংস্থা কল রেকর্ড করে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন এনটিএমসি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা-সংশ্নিষ্ট কিছু সুনির্দিষ্ট ঘটনা মনিটর করে। তারাও কোনো ধরনের কল রেকর্ড করে না। অন্য কোনো সংস্থাও কল রেকর্ড করে না। এ কারণেই কল রেকর্ড কীভাবে হচ্ছে, কীভাবে ফাঁস হচ্ছে- তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ূয়া সমকালকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে টেলিফোনে আলাপচারিতা তৃতীয় কোনো পক্ষের রেকর্ড করার আইনি বিধান নেই। কেউ করলে ও প্রকাশ করলে তা বেআইনি।
স্মার্টফোনে কল রেকর্ড :প্রযুক্তিগত তথ্য নিয়ে জানা যায়, বিশ্বখ্যাত দু-একটি ব্র্যান্ডের ‘ফ্ল্যাগশিপ’ অ্যানড্রয়েড স্মার্টফোনে গুগল ডায়ালের পরিবর্তে কাস্টমাইজড ডায়ালার রয়েছে, যেখানে ইনবিল্ট কল রেকর্ডিং সফটওয়্যার আছে; যা দিয়ে দু’পক্ষের কথোপকথন পরিস্কারভাবে রেকর্ড করা যায়। এ ধরনের ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোন ব্যবহারকারী আলাপরত যে কোনো পক্ষ তা রেকর্ড করে অসৎ উদ্দেশ্যে প্রচার করতে পারে। কিছু স্মার্টফোনে কল রেকর্ড করার জন্য গুগল প্লে-স্টোরে একাধিক থার্ড পার্টি বা তৃতীয় পক্ষ সফটওয়্যার রয়েছে।
আবার অনেক স্মার্টফোনে আন্তর্জাতিক টেলিকম ইউনিয়নের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার নীতি অনুযায়ী কল রেকর্ডের জন্য থার্ড পার্টি সফটওয়্যার ব্যবহার করতে দেওয়ার সুযোগ রাখা হয় না। গুগল ডায়ালার ব্যবহার করা কিছু স্মার্টফোন আছে, যেগুলোতে কল রেকর্ডের সময় একটি ভয়েস মেসেজ অপর প্রান্তকে সতর্ক করে- ‘আপনার কল রেকর্ড হচ্ছে।’
বিশ্বখ্যাত আইফোনে কল রেকর্ডের ইনবিল্ট সফটওয়্যার নেই এবং থার্ড পার্টি সফটওয়্যারও ব্যবহার করা যায় না। সে ক্ষেত্রে লাউড স্পিকার অন করে যে কেউ অন্য কোনো রেকর্ডিং ডিভাইস ব্যবহার করে কথোপকথন রেকর্ড করতে পারে।
তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসছে আলাপরত দুই ব্যক্তির বাইরে তৃতীয় কোনো পক্ষের আড়ি পাতার যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কল রেকর্ড করা নিয়ে। যেসব সংবেদনশীল কল রেকর্ড ফাঁস হচ্ছে, সেগুলো দূরনিয়ন্ত্রিত আড়ি পাতার যন্ত্র এবং সফটওয়্যারের মাধ্যমে তৃতীয় কোনো পক্ষ রেকর্ড করছে এমন অভিযোগই প্রকট। এই তৃতীয় পক্ষ কে- তা নিয়েই ধোঁয়াটে অবস্থা কাটছে না।
তৃতীয় পক্ষের কল রেকর্ড কতটা সম্ভব :টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদার সমকালকে জানিয়েছেন, ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনের ৯৭ ধারায় ক্ষমতা দেওয়া আছে, কিন্তু তারপরও বিটিআরসি এখন পর্যন্ত কখনোই কারও কল রেকর্ডের অনুমতি দেয়নি কিংবা কল রেকর্ড করেনি। সংশ্নিষ্ট অপারেটরদেরও ব্যবহারকারীর কল রেকর্ড করার কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বিটিআরসি গ্রাহকের জন্য উন্নত ও নিরাপদ সেবা নিশ্চিত করতেই কাজ করছে।
মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এস এম ফরহাদ জানিয়েছেন, কোনো ব্যক্তি বা গ্রাহকের কথোপকথন রেকর্ড বা ফাঁসের সক্ষমতা কিংবা আইনগত এখতিয়ার কোনোটিই মোবাইল অপারেটরদের নেই। বাংলাদেশে মোবাইল সেবাদাতারা সরকারের আইন মেনেই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
গত বছরের শুরুর দিকে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আলজাজিরার একটি বিতর্কিত তথ্যচিত্রে দাবি করা হয়েছিল, বাংলাদেশ ২০১৮ সালে ফোনে আড়ি পাতার ইসরায়েলি প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি হাঙ্গেরি থেকে কিনেছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই দাবি সম্পূর্ণ অসত্য ও উদ্দেশ্যমূলক বলে জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়।
এ ছাড়া ২০০১ সালের জুলাই মাসে প্যারিসভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফরবিডেন স্টোরিজ ও মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিশ্বের নামকরা একগুচ্ছ সংবাদমাধ্যম অনুসন্ধান চালায়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইসরায়েলি কোম্পানির তৈরি স্মার্টফোনে আড়ি পাতার পেগাসাস নামক এক স্পাইওয়্যার দিয়ে বহু দেশের, বিশেষ করে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো রাজনীতিবিদসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছে। ফরবিডেন স্টোরিজের রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু ভারতে পেগাসাস ব্যবহারের কথা বলা হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা এক রিপোর্টে পেগাসাস ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নামও উল্লেখ করে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পেগাসাস ব্যবহারের বিষয়টিও জোরালোভাবে অস্বীকার করা হয়।
কল রেকর্ডের আইনি ক্ষমতা :২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনের (২০১০ সালে সংশোধিত) ৯৭ ধারায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে কল রেকর্ড সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যে কোন টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর প্রেরিত বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোন কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবে এবং উক্ত কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারীকে নির্দেশ দিতে পারিবে এবং পরিচালনাকারী উক্ত নির্দেশ পালন করিতে বাধ্য থাকিবে।’
এ ছাড়া ‘সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ (১৮৭২ সনের ১নং আইন) বা অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনের ধারা ৯৭ক-এর অধীন সংগৃহীত কোন তথ্য বিচার কার্যক্রমে সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য হইবে।’
এই ধারা ব্যাখ্যা করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ূয়া সমকালকে বলেন, এটিই বাংলাদেশে একমাত্র আইন, যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে অনুমতি সাপেক্ষে সংশ্নিষ্ট অপারেটরদের কাছ থেকে শুধু নির্দিষ্ট কারও কল রেকর্ড সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।