সৌদি আরবে সঙ্গীত উৎসবগুলোতে ব্যাপক যৌন হয়রানির অভিযোগ
আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
একসময়ের কঠোর রক্ষণশীল রাজ্য সৌদি আরবে গণবিনোদন অনুষ্ঠান এখন আর নতুন কিছু নয়। তবে স্থানীয় এবং বিদেশী অনেক নারী অভিযোগ করেছেন যে, তারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। অনেকে আবার সেসব ঘটনার ভিডিও ধারন করে ইন্টারনেটে ছেড়েছেন।
এসব দৃশ্য এখনও সৌদি আরবের জন্য প্রায় পরাবাস্তব বলেই মনে হচ্ছে। যেখানে কয়েক বছর আগে এমনকি জনসমক্ষে সঙ্গীত পরিবেশন করাও ছিল বিতর্কিত বিষয়, সেখানে কান-ফাটানো গান বাজনার ছন্দে আমোদ-ফূর্তি করা একটু বেশিই অগ্রগতি। এমডিএলবিস্ট এর সাউন্ডস্টর্ম ইভেন্টটি চার দিন ধরে চলেছে, যেখানে কয়েক হাজার দর্শক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিজেতে নেচেছেনও।
উৎসবে নারী-পুরুষরা এমনভাবে মেলামেশা করেছেন যা সৌদি আরবে একসময় অকল্পনীয় ছিল।
তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিশ্বের বিখ্যাত শিল্পীরা সৌদি আরবের এসব অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার আগে তাদের উচিৎ ছিল দেশটির মানবাধিকারের রেকর্ড দেখা। তাদের অভিযোগ, একটি দমন-পীড়নমূলক সরকারের ভাবমূর্তিকে সাদা করতে সাহায্য করছেন এই শিল্পীরা।
বর্তমানে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ এবং দেশটির অন্যান্য স্থানের দৈনন্দিন জীবনের একটি নিয়মিত বৈশিষ্ট্য হল বিশাল বিনোদন অনুষ্ঠান। অভূতপূর্ব এসব অনুষ্ঠানে নারীদের ব্যাপকহারে যৌন হয়রানির খবরও পাওয়া যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু ভিডিও প্রচারিত হয়েছে যেগুলোতে পুরুষদের দলবেধে নারীদের হেনস্থা এবং হয়রানি করতে দেখা গেছে।
এমডিএলবিস্ট হয়রানির প্রতি জিরো টলারেন্সের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এর অনুষ্ঠানগুলোতে নারীদের জন্য সুরক্ষা বাড়াতে রেসপেক্ট অ্যান্ড রিসেট নামে একটি প্রচারণা শুরু করেছে। দর্শকদের মধ্যে যারা গত সপ্তাহে তাদের সঙ্গীত অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের এই প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন।
সৌদি কর্তৃপক্ষও ২০১৮ সাল থেকে যৌন হয়রানিকে বড় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং মোটা অঙ্কের জরিমানা ও পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের শাস্তির বিধান করা হয়েছে।
কিন্তু বেশ কয়েকজন সৌদি নারী বিবিসির সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছেন যে, তারা বিশ্বাস করেন না যে তাদের সুরক্ষায় যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে ওই নারীদের কেউই তাদের পরিচয় প্রকাশ করেননি। তার তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি।
তারা বলেছেন যে, তারা হয় নিজেরা গণবিনোদন স্থানগুলোতে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বা অন্য নারীদের হয়রানির শিকার হওয়া সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।
একজন বলেছেন যে, ইন্টারনেটে প্রকাশ করা যৌন হয়রানির ভিডিওগুলোতে যেসব মন্তব্য করা হয় সেসবে প্রায়শই নারীদের ওপরই দোষ চাপানো হয়। এবং সৌদি আইনে যৌন হয়রানির শিকার নারীরাও অপরাধীদের মতোই শাস্তি পেতে পারে।
অন্য একজন বলেছেন যে, কর্তৃপক্ষ শুধু তখনই গুরুতর প্রতিক্রিয়া দেখায় যখন কোনো বিদেশি নারী হয়রানির শিকার হন। তিনি বলেন, একজন সৌদি নারী যখন হয়রানির শিকার হন তখন খুব কম মনোযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু যখন একজন বিদেশি নারী পর্যটক হয়রানির শিকার হন তখন কর্তৃপক্ষ খুব বড় প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়।
তৃতীয় একজন নারী বলেন যে, স্থানীয় নারীদের কোনও প্রকৃত সুরক্ষা দেওয়া হয়নি। এবং হয়রানির শিকার হওয়ার জন্য নারীরা নিজেরাই দায়ী এমন ধারণাও প্রচলিত আছে, কারণ তারা ঘরের বাইরে বের হয়েছে। তিনি বলেন, এমনকি কোনো যুবতী নারী যদি হয়রানির অভিযোগ করেন, তাহলে তার নিজের পরিবার এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকেই তার নিন্দার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি আরও অভিযোগ করেন যে, সম্প্রতি জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে বিনোদন অনুষ্ঠানের স্থানগুলোতে মোবাইল ফোন দিয়ে ছবি তোলা বা ভিডিও করার বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। যার মূল উদ্দেশ্য হল যৌন হয়রানির ঘটনাগুলোর ভিডিও করা ঠেকানো।
সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং তার ঘনিষ্ঠরা বলছেন যে, এই ঘটনাগুলো অনিবার্য ছিল। কারণ সৌদি আরব সবে মাত্র ইসলামের গভীর রক্ষণশীল ব্যাখ্যা থেকে উদারতার দিকে সরে আসা শুরু করেছে। হঠাৎ করেই একটি বড় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। এমনকি রাস্তা থেকে এক সময়ের সর্বব্যাপী নৈতিকতা পুলিশও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
যুবরাজের ভিশন ২০৩০ প্রকল্পের নির্ধারিত লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য পরিবর্তনের গতি ত্বরান্বিত হতে চলেছে। সৌদি আরবের অর্থনীতিকে তেলের ওপর নির্ভরতা থেকে সরিয়ে আনার জন্য একটি বিশাল উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এবং তরুণদের প্রত্যাশার সঙ্গে মিল রেখে সমাজকে পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে।
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সমর্থকরা আরও বলছেন যে, এই প্রক্রিয়া এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এবং এই ধরনের পরিবর্তনগুলো পুরোপুরি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত মানুষকে তারা ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন।
কিন্তু যে সৌদি নারীরা বিবিসির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তারা প্রশ্ন তুলেছেন যে, এই পরিকল্পনা বাস্তবে কতটা নারী-পুরুষের অন্তর্ভুক্তিমূলক। তারা অভিযোগ করেন যে, নারীদের আশা এবং উদ্বেগগুলো এখনও শুধু হালকাভাবে নেওয়া হচ্ছে।
তারা বলেন, যৌন হয়রানির বিষয়টিই এর একটি উদাহরণ। যার ফলে অনেক সৌদি নারী এসব নতুন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। অথচ এসব অনুষ্ঠান সৌদি আরবকে শুধু পর্যটক এবং বিশ্বের প্রভাবশালীদের প্রতি উন্মুক্ত করার জন্যই নয়, বরং সৌদি আরবের নিজের নাগরিকদের কাছেও উন্মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়েই আয়োজন করা হয়েছিল।