সাতক্ষীরা মুক্ত দিবসে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের প্রতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এমপি রবির গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

মাহফিজুল ইসলাম আককাজ :

মহান স্বাধীনতার স্থপতি বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তখন থেকে দেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় এমপি রবির পিতা মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়া ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ঢাকায় পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী ঢাকা রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ করেছে। এ সংবাদ পেয়ে রাত আনুমানিক ৩টার দিকে নিউ ইলেকট্রিক ডেকারেটর থেকে মাইক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ও ঢাকায় পাকিস্থান বাহিনীর হামলার ঘটনা সাতক্ষীরাবাসীকে জানাতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা অনুযায়ী অনুযায়ী যার যা আছে তাই নিয়েই সংগঠিত হওয়ার অনুরোধ জানান। পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য ভোর রাত থেকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল মোড়ে (তৎকালীন সময়ে খুলনা রোড মোড় বলা হতো) হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে ইট বালু দিয়ে রাস্তায় অনেক উঁচু করে ব্যারিকেড তৈরী করে। উল্লেখ্য সে সময়ে আওয়ামীলীগ নেতা এ.এফ.এম এন্তাজ আলী, শেখ আবু নাসিম ময়না ও মোস্তাফিজুর রহমানসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়ার নেতৃত্বে তৎকালীন চিলড্রেণ পার্কে সাতক্ষীরার গরীব অসহায় ভিখারীদের নিয়ে রুটি বানানোর কার্যক্রম শুরু করেন। এছাড়াও বিপুল পরিমান ডাব সংগ্রহ করা হয়। সেই রুটি, ডাব ও গুড় সাতক্ষীরা থেকে যশোর চাঁচড়ার মোড় পর্যন্ত পৌছানোর ব্যবস্থা করতেন তিনি। কারণ সেখানে তৎকালীন পাকিস্থানী সেনাদের সাথে যুদ্ধ চলছিল। আমাদের দেশের যোদ্ধাদের জন্য সাতক্ষীরা থেকে ঐ খাবার পাঠানো হতো সেই এলাকায়। কারণ পাক হানাদার বাহিনী যেন সাতক্ষীরা অভিমুখে ঢুকতে না পারে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে রাস্তা কেটে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল যেন পাকিস্থানী বাহিনী সড়ক পথে সাতক্ষীরায় ঢুকতে না পারে। তৎকালীন দেশের ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনী ঐ পাকিস্থানী বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিছু দিনের মধ্যে যুদ্ধের গোলা-বারুদ ও রসদ ফুরিয়ে যায়। রসদের অভাবে ২৫ দিন যুদ্ধ করার পর পিছু হটে আসে আমাদের দেশের যুক্তিযোদ্ধারা। দেশে যখন পাকিস্থানী বাহিনী আমাদের বাঙালীদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে তখন মীর মোস্তাক আহমেদ রবি বন্ধুদের নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ভোমরায় প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করেন। ক্যাম্প স্থাপন করার পর মুসলীমলীগ নেতা গফুর সাহেবের বাড়ি থেকে সাতক্ষীরার তৎকালীন পাকিস্থানী এসডিও খালেদ খানকে আটক করে ভোমরা ক্যাম্পে নিয়ে যায় মীর মোস্তাক আহমেদ রবি ও তার বন্ধুরা। এসময় মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়ার নেতৃত্বে এসডিও খালেদ খানের অস্ত্রাগার দখল করেন এমপি রবি ও তার বন্ধুরা। সেখানে রক্ষিত সকল অস্ত্র গোলা বারুদ লুট করে তৎকালীন ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদদের মাঝে বন্ঠন করে দেওয়া হয় যুদ্ধের জন্য। এদিকে বন্দী খালেদ খানকে প্রাণে না মেরে ভারতীয় বিএসএফ’র কাছে হস্তান্তর করে এমপি রবি। এসময় খালেদ খানকে ভারতের আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়। দীর্ঘ তিন মাস পরে তাকে পাকিস্থানে পাঠিয়ে দেয় ভারত সরকার। এদিকে খালেদ খান এমপি রবির হাতে বন্দী হয়ে নিহত হয়েছে শুনে তার ভাই পাকিস্থানী মেজর হারুন খান এমপি রবির পরিবারকে মেরে ফেলার জন্য সাতক্ষীরা আক্রমণের উদ্দেশ্যে ১১৭ গাড়ি পাক হানাদার বাহিনী নিয়ে সাতক্ষীরায় প্রবেশ করে। খান সেনারা প্রথমে বর্তমান অগ্রণী ব্যাংক যেখানে এমপি রবির বাড়ি ছিল। সেই বাড়িটি হারুন খান ডেনামাইট চার্জ করে উড়িয়ে দেয়। পরে সে তার বাহিনী নিয়ে এমপি রবির দাদা বাড়ি শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কের পাশে সেই বাড়িতে ডেনামাইট চার্জ করে। ডেনামাইট অকার্যকর হলে খান সেনারা বলে ‘এ কোন আউলিয়াকা ঘর, ডেনামাইট বি নেহি ফাটতা’ বলে সেখান থেকে বেড়িয়ে এমপি রবির সুলতানপুরের বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়। উল্লেখ্য তৎকালীন সময়ে সাতক্ষীরা মহাকুমায় যে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় তার অন্যতম নেতা ছিলেন মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়া।

সাতক্ষীরায় ব্যাংক লুটের সময় ইসু মিয়ার নেতৃত্বে এমপি রবি ও তার বন্ধুরা ব্যাংক লুটে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের হাতে ভারী অস্ত্র সস্ত্র থাকায়, রবি ও তার লোকেরা প্রাণ সায়ের খালে অবস্থান নিয়েছিল। পরের দিন সন্ধ্যায় পাক সেনারা যখন সাতক্ষীরায় প্রবেশ করে তখন রবি ও তার বন্ধুরা ভোমরা ক্যাম্প ছেড়ে ভারতের টাকি জমিদার বাড়ি চলে যায় এবং সেখানে মেজর জলিলের নেতৃতে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এর পর টাকি থেকে টকিপুরে এক স্কুলে ছাত্র-জনতা নিয়ে ইয়থ ক্যাম্প স্থাপন করেন মীর মোস্তাক আহমেদ রবি। কয়েক জনকে নিয়ে এক-একটি ব্যাচ তৈরী করে ১৫ দিনের ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন তিনি। পরবর্তীতে জেনারেল ওসমানী সাহেব ক্যাম্পে এসে নৌ-কমান্ডো গঠনের জন্য ছেলেদের সংগ্রহ করতে থাকেন। তার আহবানে সাড়া দিয়ে মোস্তাক আহমেদ রবি ও তার কয়েকজন বন্ধু নেভাল কমান্ডোতে যোগ দেয় এবং ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার পলাশীর ভাগরতী নদীর তীরে নেভাল কমান্ডোদের ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। ট্রেনিং শেষে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় নৌ পথে যুদ্ধ করেন তিনি। এদিকে এমপি রবির মেঝ ভাই মীর মাহমুদ হাসান লাকি বড় ভাইকে খোঁজার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বাহির হয়ে আর বাড়ি ফিরে আসেনি। দেশ মাতৃকার টানে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে টাকি মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে যোগ দিয়ে সেখান থেকে বিহারের চকোলিয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এদিকে দুই ভাইয়ের খোঁজ না পাওয়ায় তাদের পরিবার আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারা ভাবতে থাকে দুই ভাই মনে হয় আর বেঁচে নেই। বেশ কয়েক মাস পর সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের দুদলেই পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে যুদ্ধে অংশ নেয় এমপি রবির মেঝ ভাই মীর মাহমুদ হাসান লাকি। মাত্র ৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে লাকি মুক্তিযোদ্ধা শেখ অহেদুজ্জামানের নেতৃত্বে পাক বাহিনীর প্রায় এক হাজার সৈন্যের সাথে মোকাবেলা করে বুকে গুরুতর আঘাত পায়। সেই যুদ্ধে তার বুকের হাড় ভেঙ্গে যায়। এর কিছুদিন পরে ভারতের তারাগুনিয়া গ্রামে একটি নতুন ক্যাম্প উদ্বোধন করেন খুলনার বারী এমপি। সেখানে তার নেতৃত্বে সাড়ে ১২শ’ মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। সেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেয় মীর মাহমুদ হাসান লাকি। আর ঐ ক্যাম্পের মোটিভেটর ছিলেন তাদের পিতা মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়া। উল্লেখ্য মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়ার সহকারি মোটিভেটর ছিলেন স্পীকার আব্দুর রাজ্জাক (বিএনপি আমলে)। দীর্ঘদিন পর ০৭ ডিসেম্বর শেখ আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে ৪ ট্রাংক মুক্তিযোদ্ধাসহ এমপি রবি ও তার ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মাহমুদ হাসান লাকি এবং তাদের পরিবার সাতক্ষীরায় প্রবেশ করেছিল। সাতক্ষীরা শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে ঐ সময় মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়। তখন সাতক্ষীরা আর পরাধীন নেই। এর পর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হয়েছে দেশ, বিশে^র বুকে নতুন মানচিত্র বাংলাদেশ। তাদের পিতা মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়া রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের মোটিভেটর হিসেবে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। পাকিস্থানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরার জনগণকে সংগঠিত করা ও সব শ্রেণিকে উদ্বুদ্ধ করা, খাদ্য-বস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা ও সেবাকার্য এবং আশ্রয়দান ইত্যাদি সব কাজই মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য অর্জনে তাদের পিতা মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়া ও এমপি রবির পরিবারের ভ‚মিকা আজো স্মরণ করে সাতক্ষীরাবাসী। তিনি সশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা এবং শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও এমপি রবির পরিবার মুক্তিযুদ্ধের এই অনন্য ভূমিকা এবং অবদান ইতিহাসের গৌরবময় সত্য, যা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প মোটিভেটর তাদের পিতা মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়া ও তার পরিবার দেশের স্বাধীনা অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা ও গৌরবোজ্জ্বল অবদান রয়েছে। পাকিস্থানী বাহিনী এই পরিবারের উপর ব্যাপক নির্যাতন বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগ ও ডিনামাইট চার্জ করে বধ্বংশযজ্ঞ চালিয়েছে। যুদ্ধের সেই ভয়াবহ ঘটনা মনে পড়লে আজো আতকে উঠে এমপি রবির পরিবারসহ সাতক্ষীরাবাসী।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)