সঠিক চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সেরে উঠতে পারে ব্লাড ক্যান্সার
চিকিৎসা ডেস্ক :
লিউকোমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সার। যা অত্যন্ত মারাত্মক একটি রোগ। যার এই রোগ হয়, সে সবসময় এক অজানা মৃত্যু ভয়ে দিন পার করেন। যদিও এক সময় এই ব্লাড ক্যান্সার অত্যন্ত জটিল এবং মারণ একটি রোগ ছিল। তবে সময় বদলেছে।
বর্তমানে ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়লে আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন চিকিৎসক অনুপম চক্রপাণি, অ্যাপোলো হসপিটালের হেমাটোলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট এবং অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপন বিভাগের প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর।
অনুপম চক্রপাণি জানাচ্ছেন, ব্লাড ক্যান্সার বরাবরই মারাত্মক একটি রোগ। মূলত তরুণ এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এই রোগে মৃত্যুর হার অনেকটাই বেশি। প্রতি বছর এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে ব্লাড ক্যান্সার থেকে সারিয়ে তোলার চিকিৎসা রয়েছে আমাদের কাছে।
যেকোনো বয়সে ব্লাড ক্যান্সার হতে পারে। এর ফলে রক্তের মধ্যে থাকা উপাদানগুলোর অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার ও গঠন হতে থাকে। সে লোহিত রক্ত কণিকা হোক বা শ্বেত রক্ত কণিকা হোক বা প্লেটলেট। সাধারণত ব্লাড ক্যান্সারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। একটি হলো অ্যাকিউট বা তীব্র এবং অন্যটি হলো ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী।
তীব্র ব্লাড ক্যান্সারের ফলে শরীরে হঠাৎ অপরিণত শ্বেত রক্ত কণিকার পরিমাণ বেড়ে যেতে থাকে। যেটি শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যেই সব থেকে বেশি দেখা যায়। এটি দুই প্রকারে হতে পারে, তীব্র মাইলয়েড লিউকোমিয়া এবং তীব্র লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকোমিয়া।
অন্যদিকে, দীর্ঘস্থায়ী ব্লাড ক্যান্সারের ফলে দেহে তুলনামূলকভাবে পরিণত শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। মূলত ৫০-৬০ বছর বয়সীদের মধ্যে এই রোগটি প্রায়শই দেখা যায়। এটিও দুই প্রকারে হতে পারে, দীর্ঘস্থায়ী মাইলয়েড লিউকোমিয়া এবং দীর্ঘস্থায়ী লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকোমিয়া।
এছাড়াও আরো এক ধরনের ব্লাড ক্যান্সার দেখা যায়। যেটি লিম্ফোমা আকারে হতে পারে। যেটি প্রায় ৪৫ ধরনের হতে পারে। এবং অবশ্যই তা সতর্কভাবে নির্ণয় করা উচিত। এর কয়েকটি লক্ষণ হলো- ঘাড়, কুঁচকির মতো শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে যাওয়া।
চিকিৎসক চক্রপাণির মতে, প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে তীব্র লিউকোমিয়ার তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। অন্যদিকে শিশুদের মধ্যে দুর্বলতা, অলসতা, রক্তপাত বা হঠাৎ করে জ্বরের মতো লক্ষণ দেখা যায়।
৫০ বা তার বেশি বয়স্কদের মধ্যে একাধিক মাইলোমার মতো লক্ষণ দেখা যায়। মাইলোমা হল অস্থি মজ্জার মধ্যে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। এর বিভিন্ন লক্ষণগুলো হলো হাড়ের ব্যথা, রক্তাল্পতা, কিংবা রেনাল ফেলিউর ইত্যাদি।
তীব্র ক্যান্সারের ক্ষেত্রে, রোগ নির্ণয়ের জন্য আমরা সাধারণত অস্থি মজ্জা পরীক্ষা অথবা সিটোমেট্রি পরীক্ষা করি। জানাচ্ছেন চিকিৎসক চক্রপাণি। তার মতে, ভারতে প্রায় ২০,০০০ শিশু প্রতি বছর লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়।
ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতির কথা বলতে গিয়ে ডাঃ চক্রপাণি জানাচ্ছেন, ব্লাড ক্যান্সারের ধরন একবার নির্ণয় হয়ে গেলে, তার পরে চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি উপলব্ধ রয়েছে। কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি, রেডিয়োথেরাপি ইত্যাদি। আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ রোগ নিরাময়ের জন্য অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপনও করা হয়ে থাকে।
চিকিৎসকের মতে, বাচ্চাদের লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকোমিয়া হলে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে তা নিরাময়যোগ্য। অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্কদের তীব্র মাইলয়েড লিউকোমিয়ার ক্ষেত্রে তা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ নিরাময়যোগ্য।
যেসব ক্ষেত্রে ব্লাড ক্যান্সার সম্পূর্ণভাবে নিরাময় করা যায় না, ডাঃ চক্রপাণি তাদের ক্ষেত্রে অ্যালোজেনিক বা অটোলগাস প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিচ্ছেন। এতে রোগীর আয়ু আরো ১০ থেকে ১৫ বছর বেড়ে যায়।
অন্যদিকে লিম্ফোমায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে ডাঃ চক্রপাণি রিট্যুক্সিম্যাব, ব্রেনটুক্সিম্যাব এবং নিভোলুম্যাবের মতো থেরাপির কথা তুলে ধরেছেন, যেগুলি লিম্ফোমার ক্লোনাল ক্যান্সার কোষগুলিকে আক্রমণ করে এবং মেরে ফেলে। তিনি আরো জানিয়েছেন, যদি লিম্ফোমাকে প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করা যায়, তবে ৯০ শতাংশ রোগীকে সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করা যেতে পারে।
আমাদের এখানে যে চিকিৎসা ও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা ভারত তথা বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তুলনীয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা রোগীদের রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় করে তাদের নতুন জীবন দিতে সক্ষম হয়েছি। সুতরাং যদি আপনার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে, তবে আতঙ্কিত হবেন না। আমরা আছি। এই বলেই শেষ করলেন চিকিৎসক চক্রপাণি।