প্রথমবারের মত শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পড়তে মরিয়া নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া
প্রথমবার শিরোপা জয়ের লক্ষ্য নিয়ে আগামীকাল সপ্তম টি-২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হবে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। আগের ছয় আসরে কোনবারই শিরোপার স্বাদ নিতে পারেনি এই আসরের দুই ফাইনালিষ্ট। তাই প্রথমবারের মত টি-২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জিততে মরিয়া নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া উভয় দলই।
দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায় শুরু হবে নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার ফাইনাল।
দ্বিতীয়বারের মত টি-২০ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলতে নামবে অস্ট্রেলিয়া। এর আগে ২০১০ সালে ফাইনালে উঠলেও, শিরোপার স্বাদ নিতে পারেনি অসিরা। ইংল্যান্ডের কাছে ৭ উইকেটে ম্যাচ হারে অস্ট্রেলিয়া। এরপর আর ফাইনালের টিকিট পায়নি অসিরা। সপ্তম আসরে এসে আবার ফাইনালে উঠেছে অস্ট্রেলিয়া।
সুপার টুয়েলভে ৫ ম্যাচের ৪টিতে জিতে ৮ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ রানার্স-আপ হয়ে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে অস্ট্রেলিয়া। সেমিতে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিপক্ষ ছিল শক্তিশালী পাকিস্তান। বেশিরভাগ সময়ই সেমির ম্যাচে আধিপত্য বিস্তার করে খেলেছে পাকিস্তান। নিজেদের ও অস্ট্রেলিয়া ইনিংসের ১৫ ওভার পর্যন্ত চালকের আসনেই ছিলো পাকিস্তান। কিন্তু ১৬ থেকে ১৯ ওভারের মধ্যে ম্যাচে মোড় ঘুড়িয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়ার দুই ব্যাটার মার্কাস স্টয়নিস ও ম্যাথু ওয়েড।
ষষ্ঠ উইকেটে ৪১ বলে অবিচ্ছিন্ন ৮১ রানের জুটি গড়ে সেমির লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়ার জয় নিশ্চিত করেন স্টয়নিস ও ওয়েড। অথচ পাকিস্তানের ছুঁড়ে দেয়া ১৭৭ রানের টার্গেটে ৯৬ রান তুলতেই ৫ উইকেট হারিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া।
কিন্তু পাকিস্তানের বোলিং আক্রমনের সামনে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছেন স্টয়নিস ও ওয়েড। তাতে অস্ট্রেলিয়াকে শেষ হাসিতে রাঙ্গিয়েছেন স্টয়নিস ও ওয়েড। ৫ উইকেটের জয়ে ফাইনালে উঠে অজিরা।
৩১ বলে ২টি চার-ছক্কায় অপরাজিত ৪০ রান করেন স্টয়নিস। ১৭ বলে ২টি চার ও ৪টি ছক্কায় ৪১ রানে অপরাজিত থকেন ওয়েড। এরমধ্যে ৩টি ছক্কা ওয়েড হাঁকিয়েছেন ইনিংসের ১৯তম ওভারের শেষ তিন বলে।
সেমিফাইনালে স্টয়নিস ও ওয়েডের পাশাপাশি কথা বলেছে ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নারের ব্যাট। ৩০ বলে ৩টি করে চার-ছক্কায় ৪৯ রান করেছিলেন ওয়ার্নার। এই ইনিংসের মাধ্যমে এবারের আসরে এ পর্যন্ত ৬ ইনিংসে ২৩৬ রান করেন ওয়ার্নার। ফাইনালের মঞ্চে আরো একবার ওয়ার্নারের জ্বলে উঠার অপেক্ষায় থাকবে অস্ট্রেলিয়া।
সেমিতে খালি হাতে ফিরলেও, অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩০ রান অধিনায়ক ফিঞ্চের। তবে এখনো বিশ্বকাপে জ্বলে উঠতে পারেননি স্টিভেন স্মিথ ও গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ৬ ইনিংসে স্মিথ ৬৯ রান ও ম্যাক্সওয়েল ৩৬ রান করেছেন এ পর্যন্ত।
বোলিং বিভাগে এবারের আসরে অস্ট্রেলিয়ার সেরা বোলার স্পিনার এডাম জাম্পা। শেষ চারে নিজের পারফরমেন্স অব্যাহত রেখেছিলেন তিনি। ৪ ওভারে ২২ রানে ১ উইকেট নিয়েছিলেন জাম্পা।
এ পর্যন্ত ৬ ইনিংসে তার শিকার ১২ উইকেট। এছাড়া এ পর্যন্ত দুই পেসার মিচেল স্টার্ক ৯টি ও জশ হ্যাজেলউড ৮টি উইকেট নিয়েছেন। দলের আরেক সেরা পেসার প্যাট কামিন্স, এখনও ফ্লপ। ৬ ইনিংসে মাত্র ৫ উইকেট তার। ফাইনালে জাম্পা-স্টার্ক-হ্যাজেলউডের সঙ্গে কামিন্স জ্বলে উঠতে পারলে, প্রতিপক্ষের ব্যাটারদের বিপদে পড়তে হবে।
তবে নিউজিল্যান্ডকে সমীহ করলেও ফাইনাল জিততে চান অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ। তিনি বলেন, এটি ফাইনাল ম্যাচ। আর প্রতিপক্ষ হিসেবে নিউজিল্যান্ড অনেক ক্যালকুলেটিভ দল। তারা অনেক পরিকল্পনা নিয়ে খেলতে নামবে। আমাদের সেভাবেই প্রস্তুত থাকতে হবে। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে ফাইনাল জিততে হবে এবং প্রথমবারের মত শিরোপার স্বাদ নিতে হবে।
নিউজিল্যান্ডকে শক্তিশালী ও পরিকল্পিত দল মনে করেন অস্ট্রেলিয়ার ফিঞ্চও। প্রতিপক্ষের অধিনায়কের সেই মন্তব্যের প্রতিফলন সুপার টুয়েলভ ও সেমিফাইনালে দেখিয়েছে নিউজিল্যান্ড।
সুপার টুয়েলভে পাকিস্তানের কাছে শেষ মুর্হূতে হেরে বসলেও, ম্যাচে নিজেদের সেরাটাই ঢেলে দিয়েছে নিউজিল্যান্ড। ভারতকে নাকানিচুবানি দেয়ার পর, আফগানিস্তান-স্কটল্যান্ড ও নামিবিয়ার বিপক্ষেও জয় তুলে নেয় কিউইরা। ৫ ম্যাচে ৪ জয়ে ৮ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ প্রতিপক্ষ হিসেবে নিউজিল্যান্ড পায় শিরোপার অন্যতম দাবীদার ইংর্ল্যাডকে।
ওপেনার ড্যারিল মিচেল ও জেমস নিশামের ব্যাটিং দৃঢ়তায় ইংল্যান্ডকে ৫ উইকেটে হারায় নিউজিল্যান্ড। প্রথমে ব্যাট করে ২০ ওভারে ৪ উইকেটে ১৬৬ রান করেছিল ইংল্যান্ড। ইংলিশদের রানকে টপকে যেতে গিয়ে শুরুতেই ব্যাকফুটে চলে যায় নিউজিল্যান্ড। ১৩ রানের মধ্যে মার্টিন গাপটিল ও উইলিয়ামসনের উইকেট হারায় কিউইরা।
শুরুর ধাক্কাটা পরবর্তীতে কাটিয়ে উঠেন মিচেল ও ডেভন কনওয়ে। ৬৭ বলে ৮২ রানের জুটি গড়েন তারা। ৩৮ বলে ৪৬ রান করে থামেন কনওয়ে। এরপর ব্যাট হাতে দ্রুত রান তুলে নিউজিল্যান্ডকে লড়াইয়ে ফেরান ১১ বলে ২৭ রান করে নিশাম।
আর ১৯তম ওভার পর্যন্ত ক্রিজে থেকে নিউজিল্যান্ডের জয় নিশ্চিত করেন এবারের আসরে মেইকশিপ্ট ওপেনার হিসেবে খেলা মিচেল। শেষ চারে অপরাজিত ৭২ রান করে নিউজিল্যান্ডকে প্রথমবারের মত ফাইনালে তোলেন মিচেল।
টি-২০ বিশ্বকাপে এবারই প্রথম ফাইনাল খেলছে নিউজিল্যান্ড। আগের ছয় আসরে কিউইদের সর্বোচ্চ সাফল্য ছিলো সেমিফাইনাল। ২০০৭ ও ২০১৬ সালের সেমিতে খেললেও ফাইনালে খেলার সুযোগ এবারই প্রথম হলো নিউজিল্যান্ডের।
কিন্তু প্রথমবারের মত ফাইনালে উঠেই বাজিমাত করতে চায় নিউজিল্যান্ড। দলের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন বলেন, ওয়ানডে বিশ্বকাপে শেষ দুই আসরের ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। কিন্তু টি-২০ বিশ্বকাপে এই প্রথম ফাইনাল খেলছি আমরা। শিরোপা জিতে এই প্রথমকে স্মরনীয় করতে চাই। অস্ট্রেলিয়ার মত দলের বিপক্ষে জিততে হলে, তিন বিভাগেই তাদের চেয়ে ভালো খেলতে হবে। ম্যাচের শুরু থেকেই অসিদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
পুরো আসরেই এ পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডের ব্যাটার ও বোলাররা ভাল পারফরমেন্স করেছে। দলের সেরা ব্যাটাররা রানের মধ্যেই আছেন। আসরে মিচেল ১৯৭, গাপটিল ১৮০, উইলিয়ামসন ১৩১ ও কনওয়ে ১২৯ রান করেছেন। তবে ফাইনালের মঞ্চে কনওয়ের সার্ভিস পাবে না নিউজিল্যান্ড। নিজের ভুলে হাত ভেঙে ফাইনাল থেকে ছিটকে পড়েন কনওয়ে।
সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪তম ওভারে আউট হয়ে হতাশায় নিজের ব্যাটে হাত দিয়ে আঘাত করে হাত ভেঙে ফেলেন কনওয়ে। ফলে বিশ্বকাপের ফাইনালে কনওয়েকে পাচ্ছে না নিউজিল্যান্ড। ফাইনালের আগে কনওয়েকে হারানোটা বড় ধাক্কা মনে করছেন নিউজিল্যান্ড কোচ গ্যারি স্টিড।
তিনি বলেন, এমন সময় তার ছিটকে পড়াটা হতাশার। তাকে আমরা মিস করবো। তবে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
নিউজিল্যান্ডের বোলিংকে দারুণভাবে সামাল দিচ্ছেন দুই পেসার ট্রেন্ট বোল্ট ও টিম সাউদি। টুর্নামেন্টে এ পর্যন্ত বোল্ট ১১টি ও সাউদি ৮ উইকেট শিকার করেছেন। স্পিন বিভাগে দারুন ফর্মে আছেন ইশ সোধি। ৯ উইকেট নিয়েছেন তিনি। স্পিন ঘুর্ণিতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারদর্শী সোধি। তাই ব্যাটার ও বোলারদের সমন্বয়ে ফাইনালে মঞ্চে আরো একটি শিরোপা জয়ের স্বপ্ন দেখছে নিউজিল্যান্ড।
এ বছর বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিলো কিউইরা। তবে ওয়ানডে ও টি-২০ বিশ্বকাপে প্রথম শিরোপার স্বপ্ন নিউজিল্যান্ডের।
টি-২০ ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এগিয়ে অস্ট্রেলিয়াই। ১৪ ম্যাাচে মুখোমুখি হয়ে ৯বার জিতেছে অসিরা। পাঁচ জয় অসিদের।
আর বিশ্বকাপের মঞ্চে একবার দেখা হয় অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের। সেটিতে জয় পেয়েছিলো কিউইরা। ২০১৬ সালে সুপার টেনে গ্রুপ-২এর ম্যাচে ৮ রানে জিতেছিল নিউজিল্যান্ড।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে সর্বশেষ দেখা হয়েছিলো নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার। নিউজিল্যান্ড সফরে ৫ ম্যাচের টি-২০ সিরিজ ৩-২ ব্যবধানে জিতে অসিরা।
নিউজিল্যান্ড দল : কেন উইলিয়ামসন (অধিনায়ক), টড অ্যাস্টল, ট্রেন্ট বোল্ট, মার্ক চ্যাপম্যান, এডাম মিলনে, মার্টিন গাপটিল, কাইল জেমিসন, ড্যারিল মিচেল, জেমস নিশাম, গ্লেন ফিলিপস, মিচেল স্যান্টনার, টিম সেইফার্ট, ইশ সোধি ও টিম সাউদি।
অস্ট্রেলিয়া : অ্যারন ফিঞ্চ (অধিনায়ক), অ্যাস্টন অ্যাগার, প্যাট কামিন্স, জস হ্যাজেলউড, জস ইংলিস, মিচেল মার্শ, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, কেন রিচার্ডসন, স্টিভেন স্মিথ, মিচেল স্টার্ক, মার্কুস স্টয়নিস, মিচেল সুয়েপসন, ম্যাথু ওয়েড, ডেভিড ওয়ার্নার এবং এডাম জাম্পা।