ইসলামে ভ্রাতৃত্ববোধের গুরুত্ব ও করণীয়

একজন বিশ্বাসী মুমিন নিজেকে মহান আল্লাহ তায়ালার হুকুম সমীপে নির্দ্বিধায় অর্পণ করে দেয়। তেমনিভাবে অপর মুসলমানের জন্য তার মন উতলা থাকে। যাদের মধ্যে কোনো সময় পরিচয় ছিল না। একজন আরেকজনের ভাষাও বোঝে না- এমন দুইজন মুমিনও যখন ঈমানের দাবিতে একত্রিত হয়, তখন মুহূর্তেই যেন তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে হৃদ্যতা। ভাষার সীমাবদ্ধতা, দেশের ভিন্নতা এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

জন্মগতভাবে বিশ্বের সব মানুষ রক্তসম্পর্কীয় গভীর ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। তারা সবাই মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.) এবং আদি মাতা বিবি হাওয়া (আ.)-এর সন্তান। এ কারণেই জগতের সব মানুষ পরস্পর ভাই ভাই। একই পিতামাতা থেকে জন্মগ্রহণ করে বংশপরম্পরায় মানুষ বিভিন্ন জাতি-ধর্ম, দল-মত, সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি; যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩)

স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে ভ্রাতৃত্বের ঘোষণা করে দিয়েছেন, সেই ভ্রাতৃত্বকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব তো আরো কত কারণেই সৃষ্টি হতে পারে। একই দেশের নাগরিক, একই এলাকার বাসিন্দা, একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, একই কর্মক্ষেত্রে কর্মরত ইত্যাদি কত কারণেই তা গড়ে ওঠে! তবে যত কিছুই হোক, কোরআনের ঘোষণার সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা চলে না। ঈমানি এই বন্ধন যে কেবল দুইজন ঈমানদার ব্যক্তির ঈমানের বিন্দুতে একত্রিত হওয়ার ফলে গড়ে ওঠে- বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। কোরআন ও হাদীসের নানা জায়গায় নানা আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে এ বন্ধনের গুরুত্বের কথা। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

لاَ تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتّى تُؤْمِنُوا وَلاَ تُؤْمِنُوا حَتّى تَحَابُّوا. أَوَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى شَىْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ.

তোমরা যতক্ষণ ঈমান না আনবে ততক্ষণ বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর যতক্ষণ তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি না হবে, ততক্ষণ তোমরা মুমিনও হতে পারবে না। আমি কি তোমাদেরকে একটি কাজের কথা বলে দেব, যা করলে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তোমাদের মধ্যে সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটাও। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৪

প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের পর মদীনা মুনাওয়ারার আনসারগণ হিজরতকারী মুসলমানদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের যে নমুনা প্রদর্শন করেছেন, তা সত্যিই বিরল। ঘরবাড়ি ফেলে, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে শুধুই নিজেদের ঈমান রক্ষার তাগিদে দূর মদীনায় যারা হিজরত করেছিলেন, তাদের একেকজনকে মদীনার একেকজন মুসলমানের ভাই বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। প্রিয় নবীজির হাতে গড়ে ওঠা ভ্রাতৃত্বের এ বন্ধনকে তারা এতটাই মাথা পেতে নিয়েছেন যে, তারা তাদের এ ভাইদেরকে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন, নিজেদের সম্পদে অংশীদার বানিয়ে নিয়েছেন, এমনকি কেউ কেউ তো নিজের একাধিক স্ত্রীর মধ্যে কাউকে তালাক দিয়ে নতুন এই ভাইয়ের বিয়ের ব্যবস্থা পর্যন্ত করতে চেয়েছেন।

একজন মুসলমান অন্য মুসলমানের প্রতি ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়াবে, বিপদে-আপদে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে, কল্যাণ কামনা করবে, সৎকাজের আদেশ দেবে, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে, প্রয়োজনে তার পাশে দাঁড়াবে—এমন নির্দেশনা দেয় ইসলাম। ইসলামের বিধি-বিধানগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা য়ায়, কিছু কাজ করলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হয় এবং এ সম্পর্ক আরো গভীর ও মজবুত হয়। ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ইসলাম কিছু কাজকে নিষেধ করেছে আর কিছু কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

ঠাট্টা-বিদ্রুপ না করা

ঠাট্টা-বিদ্রুপ করলে বা উপহাস করলে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমাদের কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অন্য নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না, ঈমান আনার পর কাউকে মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। যারা এ রকম কাজ থেকে তাওবা না করে তারাই অবিচারকারী।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১১)

পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ না করা

হিংসা আগুনের মতো সৎকাজকে পুড়িয়ে ফেলে। এটি শত্রুতা বাড়ায়। রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা পরস্পর মনে বিদ্বেষ পোষণ কোরো না, পরস্পর হিংসা কোরো না। একে অন্যের বিরুদ্ধাচরণ কোরো না, তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৬৫)

গালিগালাজ না করা

ইসলামে কাউকে গালিগালাজ করা হারাম। মহানবী (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকি এবং হত্যা করা কুফরি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৪৪)

পরনিন্দা না করা

গীবত বা পরনিন্দা করা হারাম ও নিষিদ্ধ। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? এটাকে তো তোমরা ঘৃণা করো। তোমরা আল্লাহকে ভয় কোরো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু। (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১০)

সম্পর্ক ছিন্ন না করা

ইসলামী শরিয়ত অনুমোদিত কারণ ছাড়া কোনো মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হারাম। রাসুল (সা.) বলেন, কোনো মুসলমানের জন্য তার ভাইকে তিন দিনের বেশি ত্যাগ করা বৈধ হবে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৬৫)

সালাম দেওয়া

মুসলিমসমাজে পরস্পর অভিবাদনের মাধ্যম সালাম। সালাম রাসুল (সা.)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। রাসুল (সা.) বলেন, আমি কি তোমাদের এমন একটি কাজের কথা বলব না, যা করলে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তা হলো, তোমরা পরস্পর বেশি বেশি সালাম বিনিময় করবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৯৮)

হাসিমুখে কথা বলা

নবীজি (সা.) সব সময় হাসিমুখে কথা বলতেন। হাসিমুখে কথা বলা সুন্নত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক ভালো কাজ সদকাস্বরূপ। আর এটিও ভালো কাজের অন্তর্ভুক্ত যে তুমি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করবে। (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৭০)

দোয়া করা

দোয়া মুমিনের হাতিয়ার। একজন মুসলমানের উচিত অন্য মুসলমানের জন্য কল্যাণের দোয়া করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি যখন তার অন্য ভাইয়ের জন্য তার অনুপস্থিতিতে দোয়া করে তখন ফেরেশতারা তার দোয়ায় আমিন বলে এবং তার জন্য অনুরূপ দোয়া করে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৩৪)

প্রয়োজন পূরণ করা

নবীজি (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের কোনো প্রয়োজন পূরণ করে, আল্লাহ তায়ালাও তার প্রয়োজন পূরণ করেন। যে ব্যক্তি তার কোনো মুসলমান ভাইয়ের পার্থিব কষ্টগুলোর মধ্য থেকে একটি কষ্ট দূর করে দেবে, আল্লাহর তায়ালা কেয়ামতের দিন তার ওপর থেকে একটি বড় কষ্ট দূর করে দেবেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪৪২)

প্রকৃতপক্ষে ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন হলো একজন মানুষ অন্য মানুষের প্রতি দয়া, মায়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন করবে। তারা একে অপরের সুখে সুখী হবে এবং একে অপরের দুঃখে দুঃখী হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তুমি মুমিনদের তাদের পারস্পরিক দয়া প্রদর্শন, পারস্পরিক ভালোবাসা প্রদর্শন এবং পারস্পরিক সহানুভূতি প্রদর্শনের ব্যাপারে একই দেহের ন্যায় দেখবে। যখন দেহের কোনো একটি অঙ্গ কষ্ট অনুভব করে তখন এ জন্য সব দেহই নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে থাকে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

অতএব, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে মানবজাতিকে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। এক দল বা গোত্র অন্য দল বা গোত্রের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের ওপর আভিজাত্য প্রকাশ করবে না। সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য সৌহার্দ্য ভাব স্থাপন করতে হবে। সমাজে মানুষে মানুষে যে সংঘাত-সহিংসতা, কলহ-বিগ্রহ, হানাহানি, খুনোখুনি, লুটতরাজ, হিংসা-বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতা চলছে, এসব অনাচার থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সবাইকে মানবতার ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)