সাতক্ষীরার বহুল আলোচিত ছাত্রলীগ নেতা সাদিকের মক্ষীরানী শিমুর আত্মহত্যা

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা :

সাতক্ষীরার বহুল আলোচিত ছাত্রলীগ নেতা ছাদিকের মক্ষীরানী সুমাইয়া আক্তার শিমু আত্মহত্যা করেছে। রোববার ঢাকার উত্তরার দক্ষিণ খান থানাধীন একটি ভাড়া বাসা থেকে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় মৃতের মামা মোখলেছুর রহমান চঞ্চল বাদি হয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে সংশ্লিষ্ট থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ছাদেক, শহরের ফুড অফিস মোড়ের অ্যাড. মোস্তফা আসাদুজ্জামান দিলুর ছেলে আসিফ জামানসহ কয়েকজনকে আসামী করা হয়েছে।

ঢাকা উত্তরার দক্ষিণ খান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শিকদার মো: শামীম জানান, সাতক্ষীরা শহরের কাছারিপাড়া ফুড অফিস মোড়ের আইনজীবী অ্যাড. মোস্তফা আসাদুজ্জামান দিলুর ছেলে আসিফ জামান একই শহরের সুমাইয়া আক্তার শিমু নামের এক নারীকে নিজের স্ত্রী পরিচয়ে এ থানাধীন একটি বাড়ির বাসা ভাড়া নেয় দু’ বছর আগে। দু’কক্ষ বিশিষ্ট ভাড়া বাসার একটিতে শিমু ও অপরটিতে সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাদিকুর রহমানের দু’ খালাতো ভাই থাকতো। সাদিক নিয়মিত শিমুর বাসায় যেত। মৃত্যুর আগে ফোনে ও মেসেঞ্জারে আসিফের সাথে শনিবার বিকেল ৪ টার দিকে কথা বলে শীমু। ময়না তদন্ত শেষে শিমুর লাশ সোমবার পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে ছিল।

এঘটনায় শীমুর মামা মো. মোখলেছুর রহমান চঞ্চল বাদী হয়ে রোববার রাতে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে ২৮ নং মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় আসিফ জামান ও সাদিকুর রহমান সাদিকসহ কয়েকজনকে আসামী করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে বাকীদের নাম বলা যাবে না। তবে আসিফ জামান সোমবার জামিন পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

এদিকে স্থানীয় একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সাদিকের পাতা ফাঁদে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন ও সাতক্ষীরা সদরের ঘোনা ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান মোশা মেয়ের বয়সী শিমুর কাছে জীবন যৌবন উৎসর্গ করে। সাদেক ওই দৃশ্য ভিডি করে ব্লাক মেইলের মাধ্যমে ওই দু’ জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করে। সাদেক ও শিমু গ্রেপ্তার হওয়ার পর সদর থানার এক পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে জানতে পেরে ওই দু’ চেয়ারম্যান ভিডিও ফুটেজ নষ্ট করতে ব্যর্থ হন।

যদিও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে তারা ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর সদর থানায় পর্ণগ্রাফি আইনের পৃথক দু’টি মামলা(২৮,২৯ নং) দায়ের করেন। বিষয়টি ভাল চোখে নেননি সাদিক। মিথ্যা মামলা করায় দু’ চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাদিক ও শিমুর সম্পর্কের অবনতি হয়। তাই পর্ণগ্রাফি আইনের মামলায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়া শিমুকে ওই দু’ জনপ্রতিনিধি তাদের ক্ষমতা বুঝিয়ে দিতে শেষ পরিণতি কি হতে পারে তা বুঝিয়ে দেন বলে অভিযোগ ওঠে। সেকারণে শুমীর মৃত্যু আত্মহত্যা সা হত্যা তা যথাযথভাবে খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে। তবে ওই দু’ চেয়ারম্যান এসব কথা অস্বীকার করে বলেন, তারা ব্লাক মেইলের শিকার হয়েছেন, শিমু আত্মহত্যা করেছে কিনা তাদের জানা নেই।

প্রসঙ্গত,২০১৯ সালের ৩ আগস্ট রাত ১১ টায় জেলা ছাত্রলীগ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের ১২ সদস্য মাছখোলা শিবতলার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আইউব আলির নিঃসন্তান বিধবা স্ত্রী হোসনে আরার জমি দখল করে অন্যদের হাতে তুলে দিতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করে একটি মেসবাড়িতে। সেখানে থাকা ছাত্রদের সাথে ঠেলাঠেলির এক পর্যায়ে সাদিকুরের পিস্তলের গুলিতে আহত হয় পৌর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেনের ছেলে ছাত্রলীগ নেতা আজমীর হোসেন ফারাবি। পরে গ্রামবাসীর তাড়া খেয়ে তারা পালিয়ে যায়।

ফারাবিকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সাদিকের আত্মীয় এক বড় মাপের জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতার প্রভাব খাটিয়ে বিষয়টি জামায়াত শিবিরের হামলার কথা বলে নিরীহ চার ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। ওই সালের ২৮ মে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা ও মারপিটে জেলা ছাত্রলীগ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুরের দেহরক্ষী সাইফুল ও মামুনুল ইসলাম দ্বীপ অংশ নেয়। এ সময় সৈয়দ সাদিকুর রহমান তার বাহিনী নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে স্লোগান দেয় ‘ সাংবাদিকদের চামড়া তুলে নেবো আমরা’।

২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর কালিগঞ্জের পিরোজপুর এলাকায় বিকাশ এজেন্ট এর ২৬ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত উজিরপুর গ্রামের সবুরের ছেলে সাইফুল ইসলাম গ্রেপ্তার হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কুত নেতা মুনজিতপুরের সৈয়দ হায়দার আলী তোতার ভাইপো সৈয়দ সাদিকুর রহমান সাদিকের ব্যবহৃত পিস্তল ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহার করা হয় বলে গ্রেপ্তারকৃত আজিজের মাধ্যমে পুলিশ জানতে পারে। ছিনতাইয়ে অংশ নিয়েছিল ছাদিকের দক্ষিণহস্ত মুনজিতপুরের মাহামুদুর রহমান দ্বীপ। ছিনতাইকৃত ২৬ লাখ টাকার মধ্যে চার লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। সাইফুল ও দ্বীপ ২৯ নভেম্বর ভোর তিনটায় পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।

তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পুলিশের জিজ্ঞাসাবদে গ্রেফতার সাদিকুর ছিনতাইয়ের কথা স্বীকার করে। সাদিকের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে একটি ও দুই চেয়ারম্যানকে নারী লোভ দেখিয়ে ভিডিও করে নয় লাখ টাকা আদায়ের দুটি পর্ণোগ্রাফির মামলা হয়। তার সহযোগী আকাশ ইসলাম , পিচ্চি রাসেল ও সুমাইয়া শিমু, অস্ত্রসহ আজিজ ও শামীকে গ্রেফতার দেখানো হয় এসব মামলায়। ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার কলাবাগান থেকে সাদিক ও সুমাইয়া আক্তার সুমিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ২৬ ডিসেম্বর সাদিককে পর্ণগ্রাফি ও অস্ত্র মামলায় চার দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করে আদালত।

পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার টিয়াখালি গ্রামের আলমাস হোসেনের ছেলে সাতক্ষীরার আমার এমপি ডট কম এর এ্যম্বাসাডোর আকাশ ইসলাম ও রাসেলকেও তিন দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করা হয়। সাদেকের হাত ধরে মুনজিতপুরের উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি ভাঙার খেলায় লক্ষ লক্ষ টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে সাদিকে বিরুদ্ধে। সংগঠনের শৃংখলা বিরোধী কাজে জড়িত থাকার দায়ে সৈয়দ সাদিকুরকে বহিস্কার এবং জেলা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষনা করে কেন্দ্রিয় ছাত্রলীগ।

২০১৮ সালে সংসদীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে শহরের একটি স্কুলের দপ্তরী সোহাগকে পিটিয়ে হত্রা করে দীপ। সাদিকের কাছের লোক হওয়ায় দীপের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ দানা বাধেনি। ২০১৮ সালের ২৬ মার্চ পৌর যুবলীগের নেতা মনোয়র হোসেন অনুকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা চেষ্টার ঘটনার নেপথ্যে সাদিকের হাত ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। শহরের মুন্সিপাড়ায় ফায়ার সার্ভিসের অফিসের পাশে একটি বাসায় সাদিক উঠতি বয়সের নারীদের নিয়ে বিশিষ্ঠজনদের নিয়ে মজার আসর বসাতো বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তবে সাদিক বরাবরই তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন তিনি পরিস্থিতির শিকার।

সর্বপরি ২০১০ সালের জুলাই মাসে সাতক্ষীরা কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে কারাফটক পার হওয়ার পরপরই একটি প্রাইভেটকারে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয় সাদেক। এরপর থেকে তাকে আর সাতক্ষীরায় দেখা যায়নি।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)