মানসিক ভারসম্যহীন লিপি’র লকডাউনে জব্দ মানুষ!

নিজস্ব প্রতিনিধি, দেবহাটা:
সর্বত্র চলছে কঠোর লকডাউন। প্রশাসন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সারতে সখিপুর বাজারমূখী মানুষের অবাধ যাতায়াত। কিছুটা দূরেই পারুলিয়া বাসস্ট্যান্ড অভিমুখে জনসাধারণকে আরোপিত বিধি-নিষেধ মানাতে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছে পুলিশের দায়িত্বরত একটি টিমের সদস্যরা।
হটাৎ সখিপুর বাজার ব্রীজের উত্তর পাশে পারুলিয়া মৎস্য সেডের সামনে রাস্তার মাঝখানে লাঠি হাতে দাড়িয়ে এক কিশোরী। বয়স সম্ভবত ১৪ থেকে ১৬ বছরের মধ্যেই। নাম তার লিপি। লাঠি হাতে রাস্তায় দাড়িয়ে সে কি করছে তা দূর থেকে দেখে ঠিকঠাক বোঝার উপায় নেই। সাইকেল, মোটারসাইকেল, ভ্যান বা যেকোন অপ্রয়োজনীয় যানবন তার কাছে যেতেই হাতে থাকা লাঠি উঁচিয়ে সেগুলোকে পুনরায় উল্টোপথে ফিরিয়ে দিচ্ছে মেয়েটি। কাছে যেতেই এসব যানবহনের চালক, আরোহী ও পথচারীরা ভালভাবেই বুঝতে পারছে মেয়েটির উদ্দেশ্য।
মুলত সর্বত্র লকডাউন চলায় সে লাঠি নিয়ে সড়কে দাঁড়িয়ে অপ্রয়োজনীয় যানবহন ও মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে। বেশভূষা আর আচরন দেখে মানষিক ভারসম্যহীন বা পাগল মনে হতে পারে মেয়েটিকে। অথচ মহামারী করোনার এই ক্রান্তিকালে সরকার ঘোষিত লকডাউন বাস্তবায়নে সড়কে নেমেছে সে।
পথচারীরা তাকে মানসিক ভারসম্যহীন বা পাগল যাই বলুক, ‘একজন সচেতন, সাহসী ও শিক্ষিত মানুষের চেয়ে মানব সেবার মহা দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে লিপি নামের ওই মেয়েটি’। রোদ, বৃষ্টি বা মানুষের তাচ্ছিল্য কোন কিছুই থামিয়ে রাখতে পারছেনা অদম্য এই কিশোরীকে।
তাইতো সচেতন মানুষের মতো মুখে মাস্ক পরে লাঠি হাতে দেবহাটার পারুলিয়া-সখিপুরের বিভিন্ন সড়কে দাড়িয়ে অযাচিত যানবহনের যাতায়াত রোধে দিনভর কাজ করছে সে। অপ্রয়োজনীয় যানবহন ও পথচারীরা কোনক্রমে পুলিশ-প্রশাসনের চেকপোস্ট পেরুতে পারলেও, লিপি’র সামনে পড়লে চুপচাপ ফিরে যেতে হচ্ছে বাড়ীতে।
রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের লোক যেই হোকনা কেন অযাচিত যানবহনসহ লিপি’র সামনে পড়ে নিস্তার নেই তার। প্রভাব খাটিয়ে তাকে টপকে সামনে এগুনোর উপায় তো নেই, বরং তর্কে জড়ালে লাঠির বাড়ি খেয়েও বাড়িতে ফিরছেন অপ্রয়োজনে বাইরে ঘোরাফেরা করতে যাওয়া মানুষেরা।
অদ্ভুত আচরণের কারনে পরিচয় জানতে চাইলে সে জানায়, তার নাম লিপি খাতুন এবং তার বাবা সখিপুরের তিলকুড়া গ্রামের লিটু নামের এক ব্যক্তি। এরপর সে আবারো ব্যস্ত হয়ে যায় যানবহনের যাতায়াত নিয়ন্ত্রন করতে। তখন সেখানে উপস্থিত স্থানীয়দের কাছে মেয়েটির সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা এলাকাবাসীর বরাত দিয়ে বলেন, বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্ক থেকে লিপি’র জন্ম হয়। ফলে সে ঠিকঠাক পিতৃপরিচয় পায়নি। তার মাও তাকে ফেলে কাজের সন্ধানে ঢাকায় চলে যায়। এরপর থেকে সখিপুর মোড় বা পারুলিয়া এলাকায় কখনো রাস্তার পাশে, কখনো দোকানের বারান্দায় আবার কখনো যাত্রী ছাউনী গুলোতে দিন-রাত কাটাতে দেখা যায় মেয়েটিকে। সে সীমিত মানসিক ভারসম্যহীন, তবে মানুষের তাচ্ছিল্যে, অনাদরে এবং প্রচলিত ‘পাগলী’ ডাকে এলাকায় লিপি পাগল নামে পরিচিতি পেয়েছে সে। গত ৮জুন কোন এক নিকৃষ্ঠ ও জঘন্য মানুষের অপকর্মের ফলে সখিপুর মোড় যাত্রীছাউনীতে ফুটফুটে এক শিশু পুত্রের জন্ম দেয় লিপি। পরে একটি পরিবার তাদের সন্তান না হওয়ায় লিপির ওই সন্তানটি লালন পালনের জন্য নিয়ে গেল আবারো পথে পথে ঘুরে দিন কাটাচ্ছে মেয়েটি। পিতৃ পরিচয় থেকে স্বীকৃতি না মেলায় আজও সে আশ্রয়হীন বলেও জানান স্থানীয়রা।
তবে সমাজের সুবিধা বঞ্চিত ও অন্যান্য সাধারণ মানুষদের মতো জীবনযাত্রা না থাকা স্বত্ত্বেও মহামারীর এই দুঃসময়ে মানুষকে সচেতন করতে এবং লাঠি হাতে লকডাউন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসা লিপি’র এমন মানবিক কর্মকান্ড সাড়া জাগিয়েছে সকলের মনে।
Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)