আশাশুনির প্রতাপনগরে ২৫ হাজার পানিবন্ধী মানুষের মানবেতর জীবন যাপন
জি এম মুজিবুর রহমান, আশাশুনি :
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর প্রভাবে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নে পাউবো’র বাঁধ ভেঙ্গে এলাকা প্লাবিত হওয়ার পর ২৫ দিন অতিবাহিত হলেও ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধ সংষ্কার সম্ভব হয়নি। ফলে পানির সাথে যুদ্ধ করে ইউনিয়নের প্রায় ৫ হাজার পরিবারের ২৫ হাজার মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে।
ইউনিয়নের মানুষ সুপার সাইক্লোন আম্ফানে বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হওয়ার পর দীর্ঘ বছরাধিক কাল পানিতে নাকানি চুপানি খেয়ে যেই ঘর গুছিয়ে নিতে শুরু করেছিল, ঠিক তখন ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর প্রভাবে পুনরায় বেড়ী বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয়। ইউনিয়নের প্রতাপনগর, কুড়িকাহুনিয়া, হরিষখালি, চাকলা, কল্যাণপুর, লস্করী খাজরা, বন্যতলাসহ ১৭টি গ্রাম পুরোপুরি বা আংশিক প্লাবিত হয়। মানুষ ঘরহারা কিংবা ঘরে বসবাসের উপযোগিতা হারিয়ে আশ্রয় কেন্দ্র, উচু স্থানে, অন্যের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। দীর্ঘ সময় ঘরছাড়া মানুষগুলো অর্থ ও খাদ্যের অভাবে অর্ধাহার বা অনাহারে দিন যাপন করছে। আবাস স্থল, রান্না, পায়খানা, সুপেয় পানি এমনকি গোসল করার মত পানির অভাবে ভুগছে। অপ্রতুল সরকারি সহায়তায় মানুষ কাজের সন্ধানে ও আয়ের পথ খুজতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এজন্য অনেকে এলাকা ছেড়ে ভিন্ন উপজেলা বা জেলায় পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছে। অনেকে দুষিত পানি ব্যবহার করে নানা রোগে আক্রান্ত হয়। শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা চরম কষ্টে পড়েছে। সড়ক পানিতে নিমজ্জিত হয়ে ও জোয়ার ভাটার টানে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ত্যি প্রয়োজনীয় মালামালের সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় অচল হয়ে গেছে। অনেক এলাকায় মানুষ মারা গেলে কবর দেওয়ার মত ভূমি পানি থেকে জেগে নেই। মসজিদ পানিতে তলিয়ে থাকায় নৌকায় চড়ে বা ভেলায় উঠে সেখানে গিয়ে হাটু পানিতে কিংবা মসজিদের ছাদে নামাজ আদায় করতে হচ্ছে।
মানুষ যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে সংসার চালাতে নাভিঃশ্বাস ফেলছে, ঠিক তখন গত ১৭ জুন থেকে শুরু হওয়া প্রচুর বৃষ্টিপাতে বসবাসের ঘরবাড়ি, জেগে ওঠা স্থান, রাস্তাঘাট জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। প্লাবনের পর যেনতেন করে কোন রকমে বসবাসের জন্য ছাবড়া/কুড়ে ঘর বা অস্থায়ী ঘর তৈরি করে আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানে বৃষ্টির পানির চাপ ও ছাউনিতে পানি ঠেকাতে না পারায় কষ্টকঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে দুর্যোগ কবলিত মানুষেরা। আম্ফানের পর এলাকার পানির একটি অংশ ভাটায় নদীতে সরে যেত। কিন্তু এখন পয়ঃ নিস্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তি বেড়েই চলেছে। সেই সাথে জ্বর, কাঁশি, সর্দি, ডায়রিয়াসহ দেখা দিচ্ছে নানান পানিবাহিত রোগ। রাস্তার পাশে ও যোগাযোগ সহজ এমন স্থানে যাদের বাড়ি তারা মাঝে মধ্যে ত্রাণ ও সরকারি বেসরকারি সহায়তা পেলেও প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকার মানুষ সবসময় ত্রাণ বি ত থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত, নি¤œ মধ্যবিত্ত, গরীব সকল শ্রেণির প্লাবিত মানুষ বিপদ সংকুল অবস্থায় রয়েছেন।
কুড়িকাহনিয়া গ্রামের আব্দুর রশিদ বলেন, আমাদের দুঃখ কষ্ট দেখার কেউ নেই। আমরাদের কষ্ট আমাদের ভিতরে রাখতে চাই। প্রতিবছর এই রকম হলে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।
কল্যানপুর গ্রামের রহিমা খাতুন জানান, বাড়িতে পানি থই থই করছে। আমাদের আর এখানে থাকার ইচ্ছে নেই। অনেকে এলাকা থেকে চলে গেছে এবং যাচ্ছে। এমন অবস্থা থাকলে আমরাও চলে যাব।
হরিষখালি গ্রামের রুহুল কুদ্দুস বলেন, বাঁধের ভাঙ্গন দেখা দেওয়ার সাথে সাথে কাজ করলে ভাঙ্গন বড় হতোনা। কিন্তু এই কাজটি করার কেউ নেই। বাঁধ ভাঙলে পানি উন্নয়ন বোর্ড তখন আসে।
প্রতাপনগরে ইউনিয়নের কুড়িকাহুনিয়া গ্রামের একাধিক ব্যক্তি জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ২৫ দিন পার হল। পানির মধ্যে বসবার করছি আমরা। আম্পানের সময় জোয়ার-ভাটা চললেও মানুষ কিছুটা স্বস্থিতে ছিলো। কারণ ভাটায় এলাকা জেগে উঠতো কিন্তু ইয়াসে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে আর কমার কোন লক্ষণ নেই। স্থানীয় মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে হরিষখালি বাঁধ দিলেও সেটা ৬ ঘন্টা পরে পুনরায় ভেঙ্গে গ্রামে পানি ঢুকেছে। রাস্তাঘাট ডুবে আছে। এখানকার মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই।
প্রতাপনগরের নাসিমা খাতুন বলেন, আম্ফানের ৯মাস পর্যন্ত জোয়ার-ভাটায় বসবার করেছি আমরা। এখন আমার বাড়ির উঠানে পানি। খাওয়ার কষ্ট, পানির কষ্ট। শুধু মানুষ নয়, গরু ছাগলসহ গবাদিপশুরাও কষ্টে আছে। অনেকে কম দামে গরু ছাগল বিক্রি করে দিয়েছে।
প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন জানান, গত বছরের ২০ মে আম্পানে ঘরবাড়িসহ হাজার হাজার গাছপালা, গবাদি পশুর ক্ষতি হয়েছে। জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে কোটি কোটি টাকার মৎস্য সম্পদ। সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছিল উপকূলবর্তী প্রতাপনগরের মানুষ। কিন্তু তারা সে সুযোগ পেলনা। ইয়াসের আঘাতে ইউনিয়নের ৬টি ওয়ার্ডের ১৭ গ্রামের ২৫ হাজার মানুষ আজও পানিবন্দি। কাজ নেই, খাবার নেই। কেউ মারা গেলে কবর দেওয়ার জায়গা নেই। ধনী-গরিব সবাই সমান হয়ে গেছে। এসব এলাকায় খাবার পানির তীব্র সংকটে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। রান্নার ব্যবস্থা না থাকায় অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে বহু মানুষ। সরকারিভাবে যে সকল ত্রাণ সহয়তা পেয়েছিলাম সব মানুষের মাঝে বিতরণ করেছি। আম্পানের পানি সরেছে তিন মাস হলো। এর মধ্যে আবারোও নতুন করে বাঁধ ভেঙে পুরো ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে নতুন করে ঘরবাড়ি, মৎস্য ঘের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সবশেষে বৃষ্টির পানির চাপে মানুষ নাজেহাল হয়ে পড়েছে। একটা ক্ষত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার আঘাত। মানুষ কীভাবে পারবে?
আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাজমুল হুসেইন খাঁন বলেন, ঘূণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে আশাশুনি সদর, প্রতাপনগর, বড়দল, আনুলিয়া, খাজরা ইউয়িনের ১৪টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়। অধিকাংশ পয়েন্টে স্থানীয় মানুষ-পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রশাসনের সহয়তায় বাঁধা সম্ভব হলেও প্রতাপনগরের ৩টি পয়েন্টে বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রতাপনগরের হরিষখালি, বন্যতলা, কুড়িকাহুনিয়া ৩টি পয়েন্ট দিয়ে এলাকায় জোয়রের পানি প্রবেশ করছে। ৫ থেকে ৬ হাজার পরিবার এখনও পানি বন্দি হয়ে রয়েছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্বে) রাশেদুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে সাতক্ষীরা এবং খুলনার কয়রার ২৫টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছিল। ইতোমধ্যে ২০টি পয়েন্ট বাঁধ দেওয়া হয়ে গেছে। খুলনার কয়রার দুটি ও সাতক্ষীরার প্রতাপনগরের ৩টি পয়েন্টে বাঁধ দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে প্রতাপনগরের কুড়িকাহুনিয়া ও হরিষখালীতে আমরা কাজ করছি। বন্যতলা পয়েন্টে জাইকার অর্থায়নে কাজ হবে। ওদের কাজ এখন শুরু হয়নি। জুন মাসের ২৬ তারিখে পূর্ণিমার কারণে নদীতে পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। আশা করছি তার আগে সকল বাঁধের কাজ শেষ হবে।