প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অজানা রোগে আক্রান্ত মানুষ: ঘুমের মধ্যে মৃত্যু
সাতরঙ ডেস্ক:
একটি গবেষণায় জানা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যে সংখ্যায় মানুষ মারা গিয়েছিল, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মারা গিয়েছিল এর সমসাময়িক সময়ের মহামারিতে। যুদ্ধে শত্রুদের চোখে দেখা গেলেও এই অদৃশ্য শত্রুকে চোখের দেখা দেখেনি কেউই। তবে এর আঘাত ছিল তাদের চেয়েও অনেক বেশি। এমন অনেক মহামারিতেই বিশ্ব বিধ্বস্ত হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ মারা গেছে অদৃশ্য ভাইরাসে। একজনের থেকে পাঁচজন। সেখান থেকে ১০। ১০ থেকে ১০০। এভাবেই বেড়েছে সংক্রমণের হার।
তেমনই আরেক মহামারির সাক্ষী হয়েছে বিশ্ব ১৯১৬ সালে। ইউরোপে তখনও চলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এটি একটি বৈশ্বিক যুদ্ধ যা ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই ইউরোপে শুরু হয় এবং ১১ নভেম্বর ১৯১৮ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ৬০ মিলিয়ন ইউরোপীয়সহ আরো ৭০ মিলিয়ন সামরিক বাহিনীর সদস্য ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম এই যুদ্ধে একত্রিত হয়। এমন বিরাট যুদ্ধ তার আগে দেখেননি কেউই। অসংখ্য যুবক প্রাণ সংশয় নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন তাদের সেনাবাহিনীর হয়ে। তাদের অসীম সাহসিকতার সাক্ষী থাকছে পুরো পৃথিবী।
তবে সেময়ের চিত্র যে শুধু এমনই ছিল তা কিন্তু না। যুদ্ধের দামামার সঙ্গে সঙ্গে তখন নতুন আতঙ্কে গোটা ইউরোপবাসী। অজানা এক রোগের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ইউরোপে। দিন দিন মহামারি আকার নিতে চলেছে। দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে মৃতের সংখ্যা। শুধু ইউরোপই নয়, কিছুদিনের মধ্যেই নিউ ইয়র্কেও ছড়িয়ে গেল সংক্রমণ। সেখানেও চোখের সামনে মারা যেতে লাগলেন অনেক মানুষ। ১০ লাখের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন এই রোগে।
আর এই রোগের উপসর্গ ছিল ঘুম। ফলেই ক্রমশ আলস্যের মধ্যে চলে যাচ্ছিলেন অসংখ্য মানুষ। সারা জীবন কেটে যাচ্ছিল শুধুই ঘুমের মধ্যে। ঘুমের মধ্যেই অনন্ত যাত্রার পথে চলে যাচ্ছিলেন অনেকে। ১৯১৬ সালে ভের্ডনের যুদ্ধ ফেরত এক সৈনিকের শরীরে প্রথম এই রোগটির প্রভাব দেখা যায়। সেনাবাহিনীতে কাজ করার কারণে স্বাভাবিকভাবেই তার শরীরের দক্ষতা ছিল অনেক বেশি। তবে হঠাৎ করেই এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা যায় তার ব্যবহারে। কোনো কাজেই যেন আর মন বসছে না।
স্থির চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকছেন অথচ যেন কিছুই দেখছেন না। আর সুযোগ পেলেই ঘুমিয়ে পড়ছেন তিনি। অনেক চেষ্টা করেও তখন সে ঘুম আর ভাঙানো যায না। এমন ঘটনায় তার পরিবারের লোকজন তো বটেই, চিকিৎসকরাও চিন্তিত হয়ে পড়েন। আর কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যায়, তিনি একা নন। একই ধরনের অসুস্থতায় ভুগছেন আরো অনেক সৈনিক। আর তাদের সংখ্যাটা দেখতে দেখতে বেড়েই চলেছে।
সবার উপসর্গই এক। আর মৃত্যুর কারণ প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই শ্বাসযন্ত্রের পক্ষাঘাত। যারা বেঁচে যাচ্ছেন তাদের আরো বেশি দুর্ভাগা বলা যায়। কেননা সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছিল। শরীরের মধ্যেই আটকে ছিল আত্মা। কোমায় কেটেছে বাকি জীবন। রোগের উৎস খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন চিকিৎসকরা। অনেকেই গবেষণা চালাতে থাকেন এ অজানা সংক্রমণ নিয়ে।কেউ কেউ বলেছেন, যুদ্ধের ক্লান্তি কাটাতেই এই ঘুম। তবে তা এক দুইদিন হতে পারে। মাসের পর মাস কীভাবে সম্ভব।
অবশেষে ভিয়েনার এক স্নায়ুবিদ, ভন ইকোনমো এর কিছু দিক বের করতে সক্ষম হন। ভন ইকোনমো লক্ষ করলেন এই রোগের প্রকোপে প্রত্যেকের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশটি ক্রমশ শুকিয়ে আসছে। আর এর ফলেই ঘুমের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে তাদের শরীরে। সেই ঘুম যে কখন চিরনিদ্রায় পরিণত হচ্ছে। তা অনেকেই টেরই পাচ্ছেন না।
ভনের গবেষণার জন্যই এই রোগ ‘ভন ইকোনমো’জ এনসেফেলাইটিস’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। আর ডাক্তারি পরিভাষায় এই রোগের নাম ‘এনসেফেলাইটিস ল্যাথার্জিকা’। তবে এর পরেও রোগের প্রকোপ আটকানো যায়নি। মানুষের শরীর থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল বহু কুকুরের শরীরেও। আর ভাইরাস সম্বন্ধে তেমন কোনো ধারণাই তখনও তৈরি হয়নি। প্রায় ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত এই রোগের প্রকোপ চলেছিল।
এরপর অ্যান্টি-ভাইরাস ওষুধের সাহায্যেই এই রোগ সারিয়ে তোলা হয়। তবে এমন বিস্ময়কর অসুখ পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই এসেছে। চার দশকের বেশি সময় ধরে এটি যে কত মানুষের প্রাণ নিয়েছে। তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। এছাড়াও যুগে যুগে নানা মহামারিতে প্রাণ দিয়েছে অনেক মানুষ। তবে এমন আজব ভাইরাস বোধহয় আর একটিও ছিল না। যার একমাত্র উপসর্গ ছিল ঘুম।