বিশ্বজয়ী বাঙালি কুস্তিগীর গোবরের আদি বাড়ি বিক্রমপুরে

সাতরঙ ডেস্ক:

মাঠে নামার আগে একটা ফরম দেয়া হলো। তাতে কিছু তথ্য লিখতে হবে। যতীন্দ্রচরণ গুহ চিমটি মেরে কাগজটুকু নিলেন, একে একে লিখতে শুরু করলেন—ওজন: ২৩০ পাউন্ড। গলা: ২০ ইঞ্চি। হাতের গোছা: ১৫ ইঞ্চি। কব্জি: পৌনে ৯ ইঞ্চি, বুক: ৫০ ইঞ্চি, বুক (ফোলালে) ৫২ ইঞ্চি, ঊরু: ৩৩ ইঞ্চি, পায়ের ডিম: সাড়ে ১৮ ইঞ্চি।

শরীরের এমন বর্ণনা দেখেই যেকেউ ভাবতে পারনে, এ তো বিদেশি কোনো বডিবিল্ডার! না; তিনি একজন বাঙালি কুস্তিগীর। যার পূর্বপুরুষরা বসবাস করতেন ঢাকায়। আসল নাম যতীন্দ্রচন্দ্র গুহ হলেও ‘গোবর গুহ’ বলেই ডাকতো সবাই।

বিংশ শতাব্দীতে অবিভক্ত ভারতের কুস্তিগীরদের ভয়ে কাঁপতো পশ্চিমারা। বিশেষত আমেরিকার কুস্তিমহল। সাদা চামড়ার পালোয়ানদের ধোবিপাটে চিৎ করে উলটে ফেলছে অপেক্ষাকৃত রুগ্ন ‘নিগার’ ভারতবাসী। তাদের নিয়ে খবরের কাগজে কত লেখালিখি! বাস্তব-কল্পনার মিশেলে ঘটছে অতিমানবের নির্মাণ। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলে দিচ্ছেন দুজন। গামা এবং গোবর। গোবরকে নিয়ে বাঙালির গর্ব কম না। এড ‘স্ট্র্যাঙলার’ লুইস থেকে সিবিস্কো কিংবা হাকেন্সমিদ, বিশ্ববিখ্যাত ‘রেসলার’দের ধরে ধরে মাটিতে আছাড় মেরছেন তিনিই। তাকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদপত্রে খবরও বেরোতো নিয়মিত; শিরোনাম এমন হতো- ‘জেন্টল জায়ান্ট’!

গোবর গুহ কে?

কুস্তির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় আঠারো শতকের শুরুর দিকে ব্রজরাম গুহের নাম। ব্রজরামরা ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের জমিদার ছিলেন। ব্রজরাম বেশিদিন বাঁচেননি, কিন্তু তার ছেলে শিবচরণ জমিদারি ও সম্পদ সুরক্ষিত রেখেছিলেন। এই শিবচরণের নাতি অম্বিকাচরণের হাত ধরেই ডন-কুস্তির নেশা ঢোকে গুহ পরিবারে।

১৮৮৯ সালের ১৩ মার্চ যতীন্দ্রচরণ বা গোবর গুহের জন্মগ্রহণ করেনে। নাতি গোবর গুহের কুস্তির নতুন নেশায় শিবচরণের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় ও বিপুল অর্থব্যয় ডন-কুস্তিকে কালে কালে সম্ভ্রান্ত গুহ বাড়ির এক কালচারে পরিণত করে। সেই সময় বাঙালি কুস্তির আখড়া হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ‘গুহদের আখড়া’।

বাঙালি কুস্তির আখড়া হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ‘গুহদের আখড়া’। ছবি: সংগৃহীত

বাঙালি কুস্তির আখড়া হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ‘গুহদের আখড়া’। ছবি: সংগৃহীত

গুহদের আখড়ায় শিক্ষার্থীদের জন্য দুধের ব্যবস্থাও করেছিলেন অম্বিকাচরণ। এই আখড়াতে প্রথম যেদিন গোবর পা রাখেন, সেদিনই সবাই বুঝেছিলেন এই ছেলে একদিন ইতিহাস গড়বে। যতীন্দ্রচরণের ছোটবেলায় তার নাদুসনুদুস চেহারা দেখে ঠাকুরদাদা অম্বুবাবু তাকে রসিকতা করে ‌‘গোবরের ড্যালা’ বলেছিলেন। সেই থেকে তার ডাকনাম হয় গোবর। ঠাকুরদাদার রসিকতায় গোবরের জেদ চেপে যায়। তিনি ঠাকুরদাদার কাছেই প্রথমিক অনুশীলন শুরু করেন। গোবরের কাকা ক্ষেত্র চরণ গুহ তাকে তৈরি করতে গিয়ে দেখেন যে, ১৫ বছর বয়সেই দু’ঘণ্টার কুস্তিতে তার কোনো দমই খরচ হয় না। ক্ষেত্র চরণ স্বামী বিবেকানন্দের কুস্তি শিক্ষাগুরুও ছিলেন বটে।

১৯১০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে গোবর পেশাদার কুস্তিগির হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। এর দুবছর পর থেকেই গোবর নিয়মিত বিলেতে লড়াই শুরু করলেন। সেই সময়ে পরাধীন ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে যে গুটিকয়েক বাঙালি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়েছিলেন, গোবর তাদের অন্যতম।

লাইট-হেভিওয়েট বিভাগে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন

গোবর গুহ ১৯২১ সালে সানফ্রানসিসকোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব মল্লযুদ্ধের প্রতিযোগিতায় লাইট-হেভিওয়েট বিভাগে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন হয়ে কলকাতা তথা ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেন। সেই লড়াইয়ে মার্কিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এড ‘স্ট্র্যাংগলার’ লুইসকে এক ঘণ্টার মধ্যে রিংয়ে আছড়ে ফেলেন গোবর। তারপর দুটি কাঁধ চেপে ধরেন জমিতে। একেবারে গুহ ঘরানার কায়দার ম্যাজিক দেখল বিশ্ব। পুরো লড়াইয়ে গোবরই আগ্রাসী ছিলেন। এবং যে সাবলীল কেতায় তিনি লুইসকে আছড়ালেন, তা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন সিবিস্কোর প্রয়োগ করা টো-হোল্ড প্যাঁচের চেয়েও চটকদার ছিল।

সেই টো-হোল্ডেই কয়েক মাস আগে লুইসকে কাত করে বিশ্ব খেতাব জিতে নিয়েছিলেন সিবিস্কো। এবং সবচেয়ে মজার হল, এই শক্তিশালী সিবিস্কোকেও হারতে হয়েছিল গোবরের কাছে!

গোবর গুহের স্বকীয়তা

কুস্তিতে লড়তে ১৯১২ সালে দুবার ইউরোপ যাত্রা করেন গোবর। প্রথমবার লন্ডন, এরপর ফ্রান্স। দুই প্রতিযোগীতাতেই তিনি কুস্তিতে বিশ্বসেরাদের সঙ্গে লড়েছেন। প্যারিসের প্রতিযোগিতায় বিশ্বের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হেভিওয়েট বিশ্বচ্যাম্পিয়নের বিরুদ্ধে লড়ে পরাজিত করেন। এরপরে তিনি স্কটল্যান্ডের সেরা কুস্তিগির ক্যাম্পবেলকে পরাজিত করেন। তারপর তিনি লড়েন স্কটল্যান্ডের আরেকজন বিখ্যাত কুস্তিগির জিমি এসনের বিরুদ্ধে।

গোবর গুহের ভাস্কর্য। ছবি: সংগৃহীত

গোবর গুহের ভাস্কর্য। ছবি: সংগৃহীত

কুস্তির পালাতে এসন সর্বক্ষণ বেআইনিভাবে মুষ্টি চালনা করা সত্ত্বেও গোবর এসনকে ভূপতিত করতে সমর্থ হন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১৯১৫ সালে দেশে ফিরে আসেন। এই তিন বছরেই সারাবিশ্বের বা মূলত পাশ্চাত্য দেশগুলোর কাছে বিস্ময় রেসলার হয়ে যান গোবর। দেশে ফিরেই তিনি দ্বিগুণ উদ্যমে নিজের কৌশল বাড়ানোর দিকে নজর দিলেন।

এই সময়ে কাঁধের আর কোমরের জোর বাড়াতে গোবর ১৬০ পাউন্ডের ভারী পাথর গলায় ঝুলিয়ে ট্রেনিং করতেন। তবে সবচেয়ে মজার ছিল গোবরের ভোজনবিলাস। কথিত ছিল তিনি খাবারের সঙ্গে সোনা আর রুপোর গুঁড়ো মিশিয়ে খেতেন গায়ের জোর বাড়ানোর জন্য! বিষয়টি নিয়ে আমেরিকান সাংবাদিকরা লেখালেখিও করেছেন।

গোবর ভারতীয় কুস্তির রীতিতে বহু নতুন প্যাঁচের উদ্ভাবন করেন। তার উদ্ভাবিত ধোঁকা, টিব্বি, গাধানেট, ঢাক, টাং, পাট, ধোবা পাট, কুল্লা ইত্যাদি ভারতীয় কুস্তি রীতিতে সংযোজিত হয়। তার সর্বাধিক প্রচলিত পদ্ধতি হলো রদ্দা।

ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অন্যরকম

সাংবাদিক ইভলিন ওয়েলস একবার তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ভারতের সবচেয়ে বড় সমস্যা কী? গোবর নির্দ্বিধায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘জাতপাত’। আজীবন অহিংসায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। কংগ্রেসের অনেক নেতা তার বন্ধু ছিলেন। কিন্তু তাদের থেকে এতটুকু সৌজন্য নেন না রাশভারী মানুষটি। বিভিন্ন  বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান। নিউইয়র্কের মডার্ন আর্টস অ্যান্ড লেটার্স-এ বক্তৃতাও দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের জীবন ও বাণী নিয়ে।

গোবর গুহের আড্ডাসঙ্গী ছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। প্রায়ই আসতেন আখড়ার বৈঠকখানায়। এলেই গোবরবাবু দেখিয়ে দেন নিজের ছেলে রতনকে, ‘ওর মগজে একটু অংক কষে দিন তো!’ হাভানা চুরুটের গন্ধে ম-ম করে আড্ডাঘর। আজীবন ওই একটিই তো বদভ্যাস বয়ে বেরিয়েছেন সংযমী কুস্তিগীর।

গোবরগুহের শেষ জীবনে আক্ষেপ ছিল। তার হাল ধরার মতো কাউকে পাননি তিনি। তাই হয়তো ক্রিকেট আর ফুটবলের জৌলুসের অনেকদূরে কুস্তীর শেষ ঘ্রাণটুকু বুকে নিয়েই ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি রাতে চিরতরে হারিয়ে গেলেন গোবর গুহ।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)