‘বুনন’-এর সহযোগীতায় স্বপ্ন বুনছেন সাতক্ষীরার শতশত নারী

মো. মুশফিকুর রহমান (রিজভি):

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার পুরাতন সাতক্ষীরা এলাকার বদ্দিপুর কলোনীর বাসিন্দা মঞ্জুয়ারা বেগম। দুই সন্তানসহ তাকে ফেলে স্বামী অন্যত্র বিয়ে করলে বিপাকে পড়েন তিনি। শিশু দুই সন্তানকে কিভাবে মানুষের মতো মানুষ বানাবেন আর কিভাবেই বা সংসার চালাবেন এই চিন্তায় যখন তার বিনিদ্র দিন কাটছে তখন এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে জানতে পারেন ‘বুনন’ নামের এক উন্নয়ন সংস্থার নাম।

এরপর ‘বুনন’ নামের সেই উন্নয়ন সংস্থা থেকে হস্তশিল্পের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে মঞ্জুয়ারা শুরু করেন পাটের ব্যাগ তৈরির কাজ। তারপর থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এখন তার সন্তানেরা ভালো স্কুলে লেখাপড়া শিখছে। সংসার চালাতেও আর কারোর উপর নির্ভর হতে হয়না তাকে।

মঞ্জুয়ারার মতো সাতক্ষীরার এমন শতশত নারীদের স্বপ্নপূরণে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে ‘বুনুন’ উন্নয়ন সংস্থা। দেশের পিছিয়ে পড়া অসহায়, অবহেলিত নারীদেরকে হস্তশিল্পের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলাই এই প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

৮ বছর আগে যাত্রা শুরু করা ‘বুনন’ উন্নয়ন সংস্থার সাথে বর্তমানে সাড়ে তিন শতাধিক নারী কর্মী আছেন। যারা বিভিন্ন সময়ে ‘বুনন’ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা ঘর-সংসার সামলানোর পাশাপাশি অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে পাটের ব্যাগ, খড় ও খেজুরপাতার ঝুড়ি, পোশাক তৈরিসহ বিভিন্ন হস্তশিল্পের কাজ করে ঘরে বসেই আয় করতে পারছেন। রোজগারের সেই টাকা দিয়ে তাদের বিভিন্ন ছোট-বড় স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। অন্যদিকে সাতক্ষীরার তৃণমূলের নারীদের তৈরি এসব পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সেখান থেকে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা।

‘বুনন’-এর প্রশিক্ষণ কর্মশালা নিয়ে প্রশিক্ষক রওশন আরা বলেন, আমি দীর্ঘ ৮ বছর ধরে ‘বুনন’-এ একজন প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমি পাটের ব্যাগ তৈরি করা শেখায়। সাতক্ষীরার অনেক নারীদের ব্যাগ তৈরি করা শিখিয়েছি। তারা এখন স্বাবলম্বী।

এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় শারমিন সুলতানা রিমা নামের এক শিক্ষার্থীর সাথে। তিনি ‘বুনন’ থেকে পাটের ব্যাগ তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি ‘বুনন’ থেকে পাটের ব্যাগ তৈরি করা শিখেছি। পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর সময়ে আমি বাড়িতে ব্যাগ তৈরি করি। ব্যাগ তৈরি করে আমি যে টাকা পায় তা দিয়ে আমি আমার লেখাপড়ার খরচ যোগায়। আগে বাবার কাছ থেকে লেখাপড়ার খরচ নিতে হতো আর এখন আমার লেখাপড়ার খরচ আমি নিজেই বহন করতে পারি।

‘বুনন’ উন্নয়ন সংস্থার সার্বিক কর্মকাÐের বিষয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নিবার্হী মামুন হাসান নাসুর সাথে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অসহায়, খেটে খাওয়া মহিলাদেরকে বিভিন্নভাবে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে একটি কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়ায় আমার মূল উদ্দেশ্য। বর্তমানে আমরা বিভিন্ন রকম হস্তশিল্প পণ্য নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে আমাদের পাটের ব্যাগ আছে, খড় ও খেজুর পাতার তৈরি ঝুড়ি এবং নকশি পোশাক আছে। এসব পণ্যগুলো আমরা দেশের বাইরের এবং দেশের ভেতরের বিভিন্ন বায়ারদের থেকে অর্ডার নিয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া নারী কর্মীদের কাছ থেকে তৈরি করে নেই।

তিনি আরও বলেন, আমাদের কর্মীদের তৈরি হস্তশিল্পের পণ্যগুলো আমরা সাধারণত বাইরের দেশগুলোতে পাঠিয়ে থাকি। জাপান, ইতালি, জার্মান, ইউএস, লন্ডনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রডাক্ট যায়। বিশেষ করে ইতালি এবং জাপানে আমাদের পাটের পণ্যগুলো বেশি বিক্রি হয়।

সরকারের কাছে হস্তশিল্পের বাজারকে আরেকটু প্রসার করার দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে যদি এই হস্তশিল্পের বাজারকে আরেকটু প্রসারিত করা যায় আর সেখানে যদি আমাদের একটু অবস্থান তৈরি করে দেওয়া যায় তাহলে আমরা আরও অনেক নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারবো। আমরা চাই শুধু সাতক্ষীরা নয় দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলের অসহায়, অবহেলিত নারীদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে। এ ব্যাপারে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)