বাঙালি ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই সবকিছু অর্জন করেছে: প্রধানমন্ত্রী
নিউজ ডেস্ক:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাঙালির ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার জন্যই ছিল না বরং এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এটি আমাদের বাঙালি জাতি হিসেবে সার্বিক অর্জনের আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে শহিদ মিনারে জাতির পিতা প্রদত্ত ভাষণের উদ্ধৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সেটা আমাদের করে দিয়ে গেছেন, যেটা ধরে রেখে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
সোমবার বিকেলে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনি ভার্চুয়ালি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ’৫২ এ রক্ত দেয়ার পরেই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছিল তা কিন্তু নয়। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারেও যেমন এই রাষ্ট্রভাষার কথা বলা হয়েছিল এবং ’৭০ এর নির্বাচনেও এই রাষ্ট্রভাষার কথা আসে। কারণ ’৫৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তখন যে শাসনতন্ত্র করা হয় তাতে উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭০ নির্বাচনের পরে ’৭১ এ আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করি এবং জাতির পিতা আমাদের যে সংবিধান দেন সেখানে বাংলা ভাষাই ছিল রাষ্ট্রীয় ভাষা। সেই মর্যাদাটাই আমরা পাই।
তিনি বলেন, ’৫৬ সালে শহিদ মিনার তৈরি করা, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়া- এসব কিছু তখন আওয়ামী লীগই করে। ’৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অনশনরত অসুস্থ বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে বের করে তার দাদা টুঙ্গিপাড়া নিয়ে গেলেও সুস্থ হয়ে ফিরেই পুনরায় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আবারো আন্দোলন শুরু করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদানের দাবি তখন জাতির পিতা তার বিভিন্ন ভাষণে করে গিয়েছেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস জানার জন্য পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোয়েন্দা রিপোর্ট নিয়ে প্রকাশিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ সিরিজের বইগুলো পড়ে দেখার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, আমি চাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এটা পড়বেন, তাছাড়া যারা গবেষণা করেন তাদের বলবো; মহামূল্যবান দলিল আপনারা এখানে পাবেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, পাকিস্তানের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোয়েন্দা রিপোর্ট নিয়ে প্রকাশিত বইগুলো ’৪৮ থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত ৭ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ভাষা আন্দোলনকালে কবে কোন লিফলেট তৈরি করে বঙ্গবন্ধু বিলি করেছেন, কোন বক্তৃতায় ভাষার কথা বলেছিলেন, কাদের নিয়ে পুনরায় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ করা হয়েছিল, কীভাবে আবার তিনি সংগ্রাম করেছিলেন এবং বারবার গ্রেফতার হন তার সব তথ্য সেখানে রয়েছে।
তিনি বলেন, এই রিপোর্ট জাতির পিতার পক্ষে নয়, ছিল বিপক্ষে প্রণীত এবং তারা তাদের ক্ষোভের বশে এটা করেছে। কারণ জাতির পিতা যেসব কাজ করছেন তা পাকিস্তানিদের পছন্দনীয় ছিল না। আর এর মাধ্যমে আমরা আমাদের ইতিহাস জানতে পারি, মহামূল্যবান তথ্য জানতে পারি। যে কারণে আমি এটা প্রকাশ করেছি। আমি জানি না পৃথিবীর আর কোন দেশে তাদের নেতার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্ট এভাবে বই আকারে প্রকাশ হয়েছে কি-না, হয়নি। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ৪৬টি ফাইলে ৪৮টি খণ্ড পাওয়া গিয়েছিল। যেখানে পাতার সংখ্যা ছিল ৪৬ হাজার পাতা। প্রায় ২০ বছর তিনি তার প্রয়াত বান্ধবী সাংবাদিক বেবী মওদুদকে নিয়ে এই বইয়ের জন্য কাজ করেছেন এবং তথ্য উদ্ধারে স্পেশাল ব্রাঞ্চেরও সহযোগিতা নিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা রক্ত দিয়ে ভাষার মর্যাদা রেখেছি। এটা শুধু আমাদের নয় সমগ্র পৃথিবীতে যাদের মাতৃভাষা রয়েছে তাদের মাতৃভাষা সংরক্ষণের জন্য এবং এর ওপর যেন গবেষণা হতে পারে সেজন্য আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছি। সেখানে ভাষা, জাদুঘর করেছি, আর্কাইভও করা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ওপর একটা মহান দায়িত্ব পড়ে গেছে সারাবিশ্বের ছোট, বড় যত ভাষাভাষী বা মাতৃভাষা রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণ করার, সেখানে রাখার এবং গবেষণার সুযোগ করে দেয়ার। পৃথিবীতে কিন্তু মাতৃভাষা সংরক্ষণের জন্য এই একটিই এতবড় ইনস্টিটিউশন গড়ে তোলা হয়েছে। আর কোথাও এর দৃষ্টান্ত নেই।
তিনি বলেন, তার সরকার এটি করতে পারায় আমাদের শহিদদের রক্ত বৃথা যায়নি। শহিদদের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি তাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে এর সুফল দেশের সব মানুষের ঘরে পৌঁছে দেব-এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী ২০০১ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানকে নিয়ে এই ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত সরকার এর নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখায় তাদের কঠোর সমালোচনা করেন।
জাতির পিতার কন্যা ‘মুজিববর্ষ’ এবং ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে’ সামনে রেখে এই দুটি উদযাপনকালে দেশের সব গৃহহীনকে অন্তত একটি ঘর করে ঠিকানা গড়ে দেয়ার এবং শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে দেশের সব ঘরকে আলোকিত করার তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় করোনাভাইরাসের টিকা নেয়া হলেও মাস্ক ব্যবহার করা, হাত পরিষ্কার করার মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় চলার মত কোভিড-১৯ প্রতিরোধ মূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতেও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তৃতা রাখেন- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী এমপি, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি, মিক্ষা এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাপা, সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, মহানগর উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান এবং দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফি। দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ আলোচনা সভাটি গণভবন থেকে সঞ্চালনা করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ’৫২ র মহান ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগ স্মরণে সবাই এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতাও পালন করেন।