সাতক্ষীরায় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ এখন ভিক্ষুক:স্টেডিয়ামের গ্যালারির নীচে পলিথিন ঘেরা ঝুপড়িতে

রঘুনাথ খাঁ:

কাত্তরে অস্ত্রহাতে বীরের মতো যুদ্ধ করে যে বাঙ্গালি সন্তানেরা মাতৃভ‚মির স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন তাদেরই একজন সাতক্ষীরার আবদুল হামিদ। ভাগ্য বিড়ম্বনায় মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীর এই সময়েও তার হাতে ভিক্ষার ঝুলি। বাড়িঘর জমি সব হারিয়ে তার আশ্রয় এখন সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামের পরিত্যক্ত গ্যালারির নিচে পলিথিন ঘেরা ঝুপড়িতে।

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের নাংলা গ্রামের হারেজ মোল্যার ছেলে আব্দুল হামিদ। আব্দুল হামিদের বড় ভাই ফজল আলী সানা ও একমাত্র বোন অমেলা। খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার মঠবাড়ি গ্রামের নানা জেহের আলী গাজীর বাড়ি থেকে হায়াতখালি মাধ্যমিকম বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়াশুনা করাকালিন পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর গ্রামের আব্দুল কাদেরের আহবানে ’৭১ এ নবম শ্রেণিতে পড়াশুনা করাকালিন মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন আব্দুল হামিদ। ভারতের বহেরায় মাসব্যাপি প্রশিক্ষন গ্রহন করে অস্ত্র হাতে নিয়ে মাতৃভ‚মি থেকে শত্র“নিধন যুদ্ধে নেমে পড়েন বীর মুক্তিযোদ্ধা হামিদ। ৮ নম্বর সেক্টরে মেজর জলিলের বাহিনীর সদস্য হিসাবে আবদুল হামিদ খুলনার চুকনগর, খুলনা ও বাগেরহাটের কয়েকটি স্থানে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। তার সহযোগী ছিলেন কয়রার কেরামত আলী ও আব্দুল জব্বার। চাচা রাজাকার আলী সানা খুলনায় রেল লাইনে ফেলে বাবা হারেজ মোল্যাকে হত্যা করে। বড় ভাই ফজর আলীকে ভাতের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হতা করে আলী সানা। পৈতৃক ২০ বিঘা নয় শতক জমি জাল জালিয়াতির মাধ্যমে দখলে রেখেফে আলী সানার আট ছেলে। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরলেও জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে আলী সানার ভয়ে সুন্দরবনে পালিয়ে যান তিনি। পরে সেখান থেকে ফিরে জমির মায়া ও বাড়ি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোন পথ ছিল না। ১৯৭৮ সালে প্রতাপনগরের রুইয়ার বিলের মান্দার সানার মেয়ে মোমেনাকে বিয়ে করেন আব্দুল হামিদ। তাদের কোন সন্তান নেই। স্থানীয় মেম্বরের কথামত নাংলা গ্রাম ছেড়ে বাস করেন ৩৫ বছর আগে তেকে সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামের পরিত্যক্ত গ্যালরির নীচে পলিথিন ঘিরে। জমি নিয়ে মামলা করে মাঝে মাঝে গ্রামে যেতেন। গত চার বছর যাবৎ শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন আর স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না তিনি। স্ত্রী মোমেনা তাকে নিয়ে ভিক্ষা করে সংসার চালান। স্টেডিয়ামের নীচ থেকে অনেকেই তাদেরকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করলেও প্রয়াত আইনজীবী অ্যাড. তপন কুমার চক্রবর্তী তাদেরেক থাকতে সহায়তা করেন। অনেকেই স্বামী আব্দুল হামিদকে ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য মোমেনাকে প্রস্তাব দেয়। বয়সের ভারে ও অসুস্থতার কারণে লাঠির উপর ভর করে ভিক্ষা করে সংসার চালানো ও ঔষধ কিনে খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া যেখানে বসবাস করেন সেখানে কোন গরম কাপড় ও একটি মাদুরও না থাকায় মানবেতর জীবন কাটছে হামিদ দম্পতির। অথচ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় হামিদের নাম নেই। কোনো ভাতাও পান না তিনি। যুদ্ধকালিন যে সার্টিফিকেট ও অন্যান্য দালিলিক কাগজপত্র পেয়েছিলেন তাও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। এখন সেই মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ খানিকটা অপ্রকৃতিস্থ। কিছুক্ষণ কথা বলার পর সারা শরীর কাঁপতে থাকে তার।

আবদুল হামিদ সানা সোমবার দুপুরে ভিক্ষা করে বাসায় ফেরার পর এ প্রতিবেদকে বলেন, শেষ বয়সে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। প্রয়োজনে তার সম্পর্কে যাঁচাই করে দেখা হোক। অন্যের দয়ায় বেঁছে থাকতে চান না তিনি। ফিরে পেতে চান পৈতৃক ভিটা। সরকারি কোন ভাতা না পেলেও করোনাকালিন পরিস্তিতিতে সেনাবাহিনী তাকে দু’ বার চাল দিয়েছে।

মোমেনা খাতুন বলেন, তাদের কোন সন্তান নেই। স্যাতসেতে জায়গায় থেকে তার স্বামী আব্দুল হামিদের দিনের পর দিন শরীর ভেঙে পড়ছে। এখন ভিক্ষা করতে নিয়ে যাওয়া ও কঠিন হয়ে পড়েছে। স্বামী মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা পেলে তিনি খুশী হবে। পেতে চার থাকার মত একটু জায়গা।
সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোলের স্টেডিয়ামের পাশের কয়েকজন দোকানী বলেন, আশাশুনির বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদের কষ্টের জীবন দেখা যায় না। তারা সরকারের কাছে আব্দুল হামিদের আশ্রয় দাবি করেন।

আনুলিয়া ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার মোক্তার হোসেন বলেন, আব্দুল হামিদ নামের কোন মুক্তিযোদ্ধার নাম তাদের জানা নেই। তাছাড়া দীর্ঘদিন কয়রা ও সাতক্ষীরায় আব্দুল হামিদকে তাদের চেনার কথা নয়। তবে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন তিনি।

আশাশুনি উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার আব্দুল হান্নান বলেন, বিষয়টি জানার পর তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সহযোগী হিসেবে কয়রার মুক্তিযোদ্ধা কেরামত আলী ও আব্দুল জব্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা হলে অবশ্যই যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য তিনি সব ধরণের চেষ্টা চালাবেন। মঙ্গলবার দুপুরে তিনি পলাশপোলে যেয়ে আব্দুল হামিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কথা বলার সময় হামিদের শারীরিক অবস্থা ও বাসস্থান দেখে কষ্ট পেয়েছেন। আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বলেন, অনেক মুক্তিযোদ্ধা জীবদ্দশায় সম্মান না পেলেও রাজাকারপন্থিরা আর্থিক সুবিধা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন।

আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর আলিফ রেজা বলেন, সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পেরে আব্দুল হামিদ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে তিনি উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডারসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে যদি তিনি মুক্তিযোদ্ধা নাও হন তাহলেও তাকে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রির গৃহযোজনার আওতায় বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।

দৈনিক সাতক্ষীরা/পিএম

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)