বাংলাদেশকে শিশুশ্রম মুক্ত করতে বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সরকার
নিউজ ডেস্ক:
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংকটের কারণে বাংলাদেশে শিশু শ্রম দূরীকরণের পরিকল্পনা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে সরকার। বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম নিরসন এবং ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে শিশুশ্রম মুক্ত করার জন্য ২৮৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
এরই মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে প্রায় এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পোশাক কারখানায় অনেক আগেই শিশুশ্রম মুক্ত রয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয় বাংলাদেশে নতুনভাবে শিশুশ্রমের প্রসার ঘটাতে পারে বলে দেশের শিশু অধিকার বিষয় নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ মনে করছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুশ্রম নিরসন ও শিশু শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছেন। এতে প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার শিক্ষক কর্মচারীর চাকরি জাতীয়করণ হয়। দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
২০১৯ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে ১৮ হাজার ১৪৭ জনকে নিয়োগ দিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এক কোটি ৪০ লাখ শিশুকে উপবৃত্তির মাধ্যমে মায়েদের কাছে টাকা প্রেরণ করা হচ্ছে, যাতে প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুরা আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ৪ থেকে ১৪ বছর বয়সী এক লাখ স্কুল থেকে ঝরে পড়া ১০ লাখ শিশুর জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যুরো ৩ হাজার ৩৩২টি শিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে একটি বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এরই মধ্যে ১ লাখ শিশু এই শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। আরো ৯ লাখ শিশুকে এই কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় ২০৫টি শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৩১ হাজার ৮৫০ জন শিশুকে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। দেশের ৬৪ জেলার ২৫০টি উপজেলায় ৭৫ হাজার শিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে ৪৫ লাখ নারী পুরুষকে সাক্ষরতা জ্ঞান প্রদান করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে ১১৬টি উপজেলায় ২১ লাখ নারী ও পুরুষকে সাক্ষরতা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সরকার ৪৯২টি উপজেলার প্রায় ২৭ হজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৯ লাখ ৯২ হাজার ৭৮০ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ৩২৮ কোটি ১৪ লাখ ১ হাজার ৯০০ টাকা জি টু পি পদ্ধতিতে (অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উপবৃত্তি অর্থ সরাসরি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর নির্ধারিত মোবাইল অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যাচ্ছে) প্রেরণ করা হয়েছে। জি টু পি পদ্ধতিতে ২০১৯ সালের পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৃত্তি প্রাপ্ত ৮৩ হাজার ৯৬৪ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ১৭ কোটি ৩২ লাখ ৭৬ হাজার ৩৮৫ টাকা প্রদান করার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করা হয়েছে। এই খাতে প্রতি অর্থবছরে বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৮৪ জনকে ১৮৭ কোটি টাকার বৃত্তি প্রদান করা হয়। বৃত্তি প্রাপ্ত অন্যান্য শিক্ষার্থীদের বরাদ্দকৃত অর্থ পর্যায়ক্রমে অনলাইনে প্রেরণ করা হচ্ছে। অনলাইনে বৃত্তি প্রদানের এ সেবাটি মুজিববর্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
শিশু উন্নয়ন সংস্থা এডুকোর মতে, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংকট বাংলাদেশ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের শিশুশ্রম বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম দূরীকরণের পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন (এসডিজি) অর্জনের অন্যতম একটি প্রতিশ্রুতিকে ব্যাহত করতে পারে।
শিশু শিক্ষা উন্নয়ন সংস্থা এডুকো বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুল হামিদ বলেন, করোনাভাইরাসের (কোভিড -১৯) কারণে অনেক পরিবারের কর্মক্ষম সদস্যগণ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। লকডাউন শিথিল করার পরপরই অনেক বিপদাপন্ন শিশুরা করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিকে উপেক্ষা করে কাজে যোগ দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। অনেকেই পরিষেবা শিল্প, গৃহস্থালি কাজ এবং ছোট উৎপাদন কারখানায় কাজে যোগ দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউনিসেফের নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ সাল থেকে শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ৯৪ মিলিয়ন কমেছে, কিন্তু এই অগ্রগতি এখন ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এডুকো মনে করে, অন্য যেকোনো দুর্যোগের মতো করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট এই সংকটে শিশুরাই সবচেয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিশুশ্রমে নিযুক্ত সব শিশু এবং তাদের পরিবারদের সরকারিভাবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। সরকারকে শিশুশ্রম সম্পর্কিত জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা সংশোধন এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যমান এবং সম্ভাব্য শিশুশ্রম প্রতিরোধ ও নির্মূলে সরকার এবং নাগরিক সমাজ ও শিশু উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে জোরালো সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতি আমাদের মানবিক দায়িত্বগুলি পালনে আরো বেশি সক্রিয় হতে হবে।
সমাজকল্যাণমন্ত্রী নূরুজ্জামান আহমেদ বলেন, সুবিধা বঞ্চিত শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমের অধীনে ৮৫টি সরকারি শিশু পরিবার, ৬টি এতিম ও প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ৩টি মহিলাদের আর্থসামাজিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ৬টি ছোট মনি নিবাস, ১টি ডে-কেয়ার সেন্টার, ১৩টি শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং তিনটি দুস্থ শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে সরকারি উপকারভোগী রয়েছে ১৭ হাজার এবংও ৩৯২০টি বেসরকারি ক্যাপিটেশন গ্রান্টপ্রাপ্ত বেসরকারি এতিমখানায় সাড়ে ৯৭ হাজার শিশু বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও মহিলা শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি শামসুন নাহার ভূঁইয়া এমপি বলেন, শিশু শ্রম নিরসনে সরকারের কর্মসূচি চলমান রয়েছে। করোনাকালীন সময়ে বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগের সুবিধা ভোগ করেছেন। সরকার আগামী ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৪ দশমিক ৫০ শতাংশে এ নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। শিশুশ্রম নিরসনে বর্তমান সরকার সুবিধা বঞ্চিত, প্রতিবন্ধী এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নে ব্যাপক ও বহুমূখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যা বাস্তবায়নে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, শিশুশ্রম নিরসনে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সরকারের দারিদ্র্য হ্রাসকরণের কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার দেশে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে আন্তর্জাতিকভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ কারণেই সরকার এ খাতে অধিক হারে বরাদ্দ দিয়ে আসছে। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে আরো সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির হার বাড়ানো, ঝরে পড়া শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি, শিক্ষার গুনগত মানোন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে।