খননের সাথে সাথেই মাটি পড়ে নদী ভরাট : ২শ’ গ্রাম তলিয়ে যাবার শঙ্কা!
যশোর : যশোরের ভবদহ অঞ্চলের বাসিন্দারা বিগত ৪০ বছর ধরে জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে আসছে। সরকার প্রতিবছর প্রকল্প নিলেও তা জনগণের কাজে আসছেনা। এখন ভরা বর্ষা মৌসুম। ইতোমধ্যে বৃষ্টিতে পলি জমে ভবদহ স্লইস গেট বারো আউলিয়া মোহনা পর্যন্ত প্রায় ৬০ কিলোমিটার ভরাট হয়ে গেছে। খননের সাথে সাথেই মাটি পড়ে ভরাট হচ্ছে। এতে জেলার ৪টি উপজেলার ২শ’ গ্রাম পানির নীচে তলিয়ে যাবার শংকা রয়েছে। যার শিকার হবে ১০ লাখ মানুষ।
এরই মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড আবারও ৮০৮ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়ে। যার প্রতিবাদে আগামী ৯ আগস্ট স্মারকলিপি দেবে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি। গড়ে তোলা হবে গণআন্দোলন। গতকাল এক সাংবাদিক সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন কমিটির নেতারা।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির যুগ্মসমন্বয়ক গাজী আবদুল হামিদ জানান, বিল বোকর, বিল কেদারিয়া, আড়পাতার বিল, বিল কপালিয়াসহ বিভিন্ন বিলগুলোতে পানি ভরে গেছে। ইতোমধ্যে ডুমুরতলা, সুজতপুর, ডহর মুশিহাটি, হাটগাছা নেবুগাতি, বেদভিটা, বরারাবাদ গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। স্লইস গেট বারো আউলিয়া মোহনা পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার ভরাট হয়ে গেছে। বিষয়টি আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানালেও তারা আমলে নিচ্ছেনা। যথাসময়ে টিআরএম বাস্তবায়ন হলে এটি হতো না। ভারি বর্ষা হলে যশোর সদরের একটি অংশ, মণিরামপুরের ৭০টি, কেশবপুরের ৫০টি ও অভয়নগর উপজেলার ৪০টিসহ ২শ গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাবে। এতে আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে ১০ লাখ মানুষ।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব চৈতন্য কুমার পাল জানান, সরকার প্রতিবছর পাইলট চ্যানেলের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অপচয় করছে। কিন্তু আমরা জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পাচ্ছিনা। পানি উন্নয়ন বোর্ড মণিরামপুরের লখাইডাঙ্গা ব্রিজ থেকে টেকাব্রিজ পর্যন্ত ২ দশমিক ১০ কিলোমিটার এবং আমডাঙ্গা খাল রেগুলেটর থেকে ভৈরব নদ পর্যন্ত ২ কিলোমিটার খননকাজ করছে সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে। যেখানে কোনো ফল আসেনি। এতে অর্থলোপাট হয়েছে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, জলাবদ্ধতা ঠেকাতে শ্রী, হরি ও টেকা নদীতে পাইলট চ্যানেল কাটা হচ্ছে। টেকা নদীতে যখন এই খননকাজ চলছে, তখন শ্রী ও হরি নদী ভরে উঠছে পলিতে। আবার টেকা নদীতে যেটুকু খনন করা হচ্ছে, সাগর থেকে জোয়ারের সাথে উঠে আসা পলি এবং খননের মাটি পড়ে সেটুকুও সঙ্গে সঙ্গে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমানে এলাকার কোনো বিলে জোয়ারাধার (টিআরএম-টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) কার্যকর নেই। এই অবস্থায় এলাকার পানি নিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদীতে ব্যাপকহারে জমছে পলি। এলাকার ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের আশঙ্কা করছেন, বৃষ্টিপাত বেশি হলে বৃষ্টির পানি জমে অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা এবং যশোর সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে ভয়াবহ ও জলাবদ্ধতা দেখা দেবে।ৎমণিরামপুর উপজেলার পাঁচকাটিয়া গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য আদিত্য মল্লিক বলেন, ‘ যে পরিমান মাটি কাটা হচ্ছে এক জোয়ারে পলি পড়ে তার চেয়ে বেশি নদী ভরাট হচ্ছে। নদী কেটে মাটি নদীর পাড়েই ফেলা হচ্ছে। ওই মাটি নদীতে পড়ছে। টিআরএম ছাড়া নদী বাঁচানো যাবে না।’
যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। ভবদহ অঞ্চলের পানি নিষ্কাশিত হয় মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী দিয়ে। যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার পাশে মজ্জাতের বাওড়ের বিপরীত দিকে ভৈরব নদ থেকে থেকে উৎপত্তি হয়ে মুক্তেশ্বরী নদী যশোর সদর ও মণিরামপুর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর অভয়নগর উপজেলার গোঘাটা নামক স্থানে টেকা নাম ধারণ করেছে নদীটি। টেকা নদী উপজেলার ভবানীপুর এলাকায় শ্রী নদীতে পতিত হয়েছে। শ্রী নদী কিছুদূর এগিয়ে মণিরামপুর উপজেলার কপালিয়ায় হরি নদীর সাথে মিশেছে। হরিনদী খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গ্যাংরাইল নদীতে পতিত হয়েছে। সাগর থেকে আসা জোয়ার প্রতিদিন দুইবার নদীগুলো দিয়ে ভবদহ অঞ্চলে প্রবেশ করে। আবার একইভাবে সাগরে ফিরে যায়। কিন্তু পলি পড়ে মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। এই অবস্থায় গত কয়েক বছর বর্ষা মৌসুমে ভবদহ অঞ্চলের অসংখ্য বাড়িঘর, রাস্তা, মাছের ঘের, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে যায়। অবর্ণনীয় দুভোর্গের শিকার হয় এলাকার প্রায় চার লাখ মানুষ। এবারও সেই আশঙ্কায় গ্রামের মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর কার্যালয় সূত্র জানায়, ভবদহ এলাকায় যাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় সে জন্য মুক্তেশ্বরী, টেকা শ্রী ও হরি নদীতে ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘে পাইলট চ্যানেল খনন করা হচ্ছে। এ জন্য দুই কোটি ৫৫ লাখ ১২ হাজার ৭২৭ টাকা ৩৩ পয়সা ব্যয়ে তিনটি প্যাকেজে এ খনন কাজ চলছে। এর মধ্যে দুটি প্যাকেজে ৯৮ লাখ ৪০ হাজার ৩৬৮ টাকা ৪৬ পয়সা ব্যয়ে কাজ পেয়েছেন যশোরের মণিরামপুরভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স তানিন ট্রেডার্স। আর এক কোটি ৫৬ লাখ ৭২ হাজার ৩৫৮ টাকা ৮৬ পয়সা ব্যয়ে অপর প্যাকেজে কাজ পেয়েছেন চুয়াডাঙ্গার জীবননগরভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জাকাউল্লাহ অ্যান্ড ব্রাদার্স। কিন্তু তিনটি প্যাকেজেরই কাজ করছেন মেসার্স তানিন ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী শরিফুল ইসলাম। সব প্যাকেজে চারটি এক্সাভেটর থাকবে। দুটি এক্সেভেটর নদীর মধ্যে চ্যানেল কেটে মাটি পাড়ে ওঠাবে এবং অপর দুটি এক্সেভেটর মাটি অন্যত্র সরিয়ে ফেলবে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী শুকিয়ে ছোট খালের মতো হয়ে গেছে। ভবদহ জলকপাটের (স্লুইসগেট) সামনে শ্রী নদীতে পলি জমে উঁচু হয়ে গেছে। ৯ কপাটের (ভেন্ট) উজান ও ভাটিতে শ্রী নদীতে পাইলট চ্যানেল কাটা জায়গায় পলি জমে অনেকটা উঁচু হয়ে আছে। নদীতে একটুও পানি নেই। ত্রিমোহিনী এলাকায় দুটি এক্সেভেটর দিয়ে নদী খনন করা হচ্ছে। নদীর মাটি কেটে পাড়ে স্তুপ করে রাখা হচ্ছে। পাড়ের মাটি অনেকটা অংশ ভেঙে নদীর মধ্যে পড়ছে।
অভয়নগর উপজেলার বারান্দী গ্রামের কৃষক রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, ‘নদী কেটে কোনো লাভ হচ্ছে না। এক জোয়ারেই পলিতে কাটা জায়গার চেয়ে বেশি নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পাড়ে ফেলা মাটিতেও নদী ভরাট হচ্ছে। টিআরএম ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।’
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতারা জানান, ভবদহ অঞ্চলে জোয়ারাধার বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ যশোরে অনুষ্ঠিত এক জাতীয় কর্মশালায়। এজন্য ২০১৮ জানুয়ারি মাসে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রায় ৪৪৮ কোটি ৭১ লাখ ২৩ হাজার টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের যাচাই কমিটির বৈঠকে জোয়ারাধার প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ আমাদের প্রতিনিধি জেমস আব্দুর রহিম রানাকে বলেন, ‘নদী কেটে নদী বাঁচানো যায় না, নদীর প্রবাহ নিশ্চিত করেই কেবল নদী বাঁচানো সম্ভব। নদী বাঁচাতে সাগর থেকে উঠে আসা পলি বিলে বিলে ধারণ এবং উজানের পানি প্রবাহের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘গত চার বছর ধরে কেবল নদী কাটা হচ্ছে। এতে নদীর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এ বছর নদীগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। সমস্যা সমাধানে টিআরএমের বিকল্প নেই। এক গভীর ষড়যন্ত্রের কারণে গৃহিত বিল কপালিয়ার টিআরএম প্রকল্পটি বাতিল করা হয়েছে। আর অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিনা টেন্ডারে পর পর থোক-বরাদ্দ দিয়ে নদী খননের নামে পাইলট চ্যানেলের কাজ করা হচ্ছে যা কোনো স্থায়ী বা টেকসই সমাধান নয়। এতে রাষ্ট্রের অর্থ লোপাট করা হচ্ছে। মহল বিশেষ এই অর্থ লোপাটের সুযোগ পাচ্ছে।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স তানিন ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘নদীতে পাইলট চ্যানেল কাটার তিনটি প্যাকেজের কাজ আমি করছি। ঠিকমতো কাজ করা হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করবো।’ তিনি বলেন, নদী দিয়ে প্রচুর পলি আসছে। নদী থেকে মাটি কাটা হচ্ছে কিন্তু মাত্র দুই দিনের পলিতে সেখানে দেড় থেকে দুই ফুট ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, যশোরের কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী তৌহিদুল ইসলাম বলেন,‘পলিতে নদী ভরাট হয়ে গেছে। এজন্য পাইলট চ্যানেলের মাধ্য খননকাজ চলছে। ‘চ্যানেল কাটার পরও নদী ভরাট হয়ে গেছে। এগুলো বর্ষা মৌসুমে করা হয়। টিআরএমসহ নদী খননে আমরা মন্ত্রণালয়ে ৮০৮ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব দিয়েছি। সেটি পাস হলে ভবদহে জলাবদ্ধাতা দূর হবে বলে আমরা আশাবাদী।
Please follow and like us: