বিশ্বের সবচেয়ে বড় আশ্রয়ণ কেন্দ্র প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশ
‘ঘরের চালা ফুটো। সারাদিনের বৃষ্টিতে টপটপ পানি পড়ে। ভিজে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে আমাদের বেঁচে থাকাটাই ছিল কষ্টের। বস্তির মতো ঝুপড়ি ঘর থেকে একেবারে বিল্ডিংয়ে তুলে নিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। আল্লাহ তাকে আরো দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখুন।’ কথাগুলো বলছিলেন কক্সবাজার ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে’ আধুনিক ফ্ল্যাট পাওয়া বৃদ্ধ আলতাফ মিয়া।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে উদ্বাস্তুদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি তত্ত্বাবধানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আশ্রয়ণ কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে কক্সবাজারে। জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার পুনর্বাসনে বিশ্বে এটিই প্রথম কোনো আশ্রয়ণ প্রকল্প।
১৯৯১ সালে ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের পর ভিটে মাটি হারানো মানুষগুলো কক্সবাজার সদরের এয়ারপোর্ট সংলগ্ন কুতুবদিয়া পাড়ায় বসবাস করছিলেন। দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করা এই স্থানে তারা জর্জরিত হয়েছেন আর্থিক ও সামাজিকসহ অনেক অনিশ্চয়তায়। দুর্যোগ থেকে বাঁচতে দূর্ভোগকে সঙ্গী করে নিয়েছিলেন এই মানুষগুলো। নবনির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পে নিজেদের স্থায়ী ঠাঁই হওয়ার খবরে নতুন স্বপ্ন দেখছেন তারা।
কক্সবাজার সদরের খুরুশকুলে ১ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫তলা বিশিষ্ট ১৩৯টি ভবনের মধ্যে ২০টির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৬শ’ পরিবার পাবেন সুদৃশ্য অ্যাপার্টমেন্ট। আগামীকাল প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্থায়ী আবাসনের সুযোগপ্রাপ্ত ৬শ’ পরিবারের মধ্যে নেছার আলী একজন। তার অনুভূতির কথা জানাতে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, দীর্ঘকাল ধরে আমাদের খোঁজ কেউ নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে আমরা নতুন আশ্রয়স্থল খুঁজে পেতে যাচ্ছি। আমরাও যে মানুষ তা নিজেরাই ভুলতে বসেছিলাম। কিন্তু আমরা নতুন স্বপ্ন বুনতে শিখেছি। আমাদের সন্তানগুলোও এখন মানুষ হবে।
জানা যায়, এই আশ্রয়ণ কেন্দ্রে শুধু আবাস নয়, আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলোর স্থায়ী পুনর্বাসন ও আর্থিক সচ্ছলতা আনতেও সরাসরি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। পাঁচতলা বিশিষ্ট প্রত্যেকটি ভবনে বাস করবে ৩২টি পরিবার। সাথে থাকবে উপাসনালয়, স্কুলসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধাও। এখানে বাস করা মৎস্যজীবীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হবে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আনন্দের উৎসবে মেতে উঠেছে কুতুবদিয়া পাড়া। কেউ আনন্দে চোখের পানি ফেলছেন। কেউবা উজ্জ্বল চোখে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আঁকছেন। এক কোনায় বসে মাথায় টুপি দিয়ে বসে আছেন নজির হোসাইন। তার সাথে কথা বলতে গেলে বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, আমরা বন্যা এলাকায় ছিলাম। এখানে একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। নিজেদেরকে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বলে মনে হতো। নিয়তিকে মেনেও নিয়েছিলাম। পরিবার নিয়ে খুপড়ির মাঝে জীবনযাপন করছিলাম। এখান থেকে হঠাৎ টেনে নিয়ে পাঁচতলায় তুলে দিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।
কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা খুঁজে না পাওয়া মৎস্যজীবী আব্দুল হক বলেন, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে আমরা নিজেদের আবাসে ফিরতে পারবোনা, এমনটা ভাবতেই কান্না পেয়ে যেতো। সেখানে আমার অনেক ব্যবসায়, জায়গা-জমি ছিল। সব হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়ি। এখানে এসে আয়-ইনকামের পথও সহজে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে মাছ ধরাকেই পেশা হিসেবে নিয়ে দু-বেলা খেয়ে পরে বেঁচেছিলাম। কিন্তু এখন স্বপ্ন দেখছি। আমার সন্তানরাও ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুযোগ পাবে।
প্রকল্প পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন জানান, প্রকল্প এলাকায় ১৪টি খেলার মাঠ, সবুজ জায়গা, মসজিদ, মন্দির, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পুলিশ ও ফায়ার স্টেশন, তিনটি পুকুর, নদীতে দুটি জেটি, দুটি বিদ্যুতের সাবস্টেশন থাকবে। এছাড়াও থাকবে ২০ কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ৩৬ কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বর্জ্য পরিশোধন ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, তীর রক্ষা বাঁধ, ছোট সেতু, পুকুর ও খাল।
তিনি আরো জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পে যারা ফ্ল্যাট পাবেন তাদের ঋণ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা হবে। প্রকল্প এলাকায় একটি শুঁটকি মহালও থাকবে এবং এখানে পর্যায়ক্রমে বিক্রয় কেন্দ্র ও প্যাকেজিং শিল্পও গড়ে তোলা হবে। ২০২৩ সালে পুরো প্রকল্পের যখন শেষ হবে, তখন এখানে যে কেবল ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবার আশ্রয় পাবে, তা নয়। প্রায় ১০০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হবে আধুনিক পর্যটন জোন।