সাহেদকে ভারতে পালাতে সহায়তাকারী এই বাচ্চু মাঝি কে?

করোনা ভাইরাসের ভুয়া টেস্ট ও জাল সনদ প্রদানের ঘটনায় দেশব্যাপী বহুল আলোচিত সমালোচিত মহাপ্রতারক ৬০ মামলার আসামী রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমকে দেবহাটার শাঁখরা কোমরপুর সীমান্ত থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারের পর তাকে ভারতে পালাতে সহযোগীতাকারী হিসেবে যে নামটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এবং র‌্যাবের মামলার পলাতক আসামীর তালিকায় উঠে এসেছে সেটি হলো কথিত ‘বাচ্চু মাঝি’।

মুলত র‌্যাবের অভিযানে যে নৌকাটিতে করে পালানোর প্রাক্কালে মহাপ্রতারক সাহেদ করিম ভারতে পালানোর চেষ্টা করছিলেন বলে র‌্যাব সদস্যরা জানিয়েছে, সেই নৌকারও মালিক সনৎ কুমার মন্ডল ওরফে বাচ্চু খোঁড়া ওরফে বাচ্চু মাঝি। তিনি দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের শাঁখরা কোমরপুর গ্রামের দূর্গা মন্দিরের পাশ্ববর্তী এলাকার মৃত অশ্বিনী মন্ডল ও শতবালা পাড়ুই দম্পতির ছেলে।স্বাধীনতা যুদ্ধেরপর বাল্যকালে পাক বাহিনীর পুতে রাখা মাইন কুড়িয়ে পেয়ে খেলা করার সময় তা বিষ্ফোরনে সনৎ কুমার মন্ডল ওরফে বাচ্চুর বাম পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই থেকে এলাকার মানুষ তাকে বাচ্চু খোঁড়া নামেই ডাকতেন। একটি পা না থাকায় বিয়ের পর স্ত্রী সাবিত্রী মন্ডলকে সাথে নিয়ে সীমান্তবর্তী ইছামতি নদীর সাথে সংযুক্ত শাখা নদী শাঁখরার লাবণ্যবতীতে নৌকায় করে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। এরপর থেকে ওই এলাকায় তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন বাচ্চু মাঝি নামেই।

২০১৯ সালের অক্টেবর মাসে হার্টস্ট্রোক হলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে চিকিৎসার জন্য বাচ্চু মাঝি ওরফে সনৎ কুমার মন্ডলকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অতিদারিদ্র হওয়ায় বাচ্চু মাঝির পুর্ন চিকিৎসার ভার বহন করতে পারেনি তার পরিবার। একপর্যায়ে চিকিৎসারত অবস্থায় বাড়ীতে আনার পর ২৭ অক্টোবর মারা যায় বাচ্চু মাঝি। বাচ্চু মাঝির মৃত্যু সনদেও নিশ্চিত হয়েছে বিষয়টি।
বাবার মৃত্যুর পর পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার চালাতে বাচ্চু মাঝির রেখে যাওয়া একমাত্র সম্বল সেই নৌকাটির মালিক হন ছেলে সুব্রত মন্ডল। বাবার নৌকাতেই এযাবৎ লাবণ্যবতীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে সে। বাকি সময়ে এলাকার বিভিন্ন মানুষের ঘেরে জাল টেনে মাছ ধরার কাজও করে সুব্রত।তবে যে নৌকাটিতে করে মহাপ্রতারক সাহেদ ভারতে পালানোর চেষ্টা করছিলো বলে র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে সেটি ওই মৃত বাচ্চু মাঝি ওরফে সনৎ কুমার মন্ডলের। যা এখন পরিচালনা করেন সুব্রত মন্ডল।

বুধবার (১৫ জুন) ভোরে শাঁখরা কোমরপুর সীমান্তের লাবণ্যবতীর তীরে অভিযান চালিয়ে দেশব্যাপী আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মহাপ্রতারক সাহেদকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে এলিট ফোর্স র‌্যাব।
মুলত যে স্থান থেকে সাহেদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো তার বিপরীতে নদীর অপর পাড়ের বাঁধা ছিলো সুব্রত মন্ডলের নৌকাটি। তবে র‌্যাবের অভিযানের আগেই প্রতিদিনের মতো নৌকাটি লাবণ্যবতীর পাড়ে বেধে রেখে অন্যের ঘেরে জাল টেনে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন বলে দাবী বাচ্চু মাঝি ওরফে সনৎ কুমার মন্ডলের ছেলে সুব্রত মন্ডলের।
এদিকে প্রতারক সাহেদকে গ্রেপ্তারের পর বুধবার রাতেই মহাপ্রতারক সাহেদকে প্রধান আসামীসহ জনৈক বাচ্চু মাঝি নামের একজনকে পলাতক আসামী ও অজ্ঞাত অপর আরেক ব্যাক্তিকে আসামী করে খুলনা র‌্যাব-৬ এর সাতক্ষীরা সিপিস-১ এর ডিএডি নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে ১৯৭৮ সালের আর্মস এ্যাক্টের ১৯ (এ) তৎসহ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ এর বি (এ) ধারায় দেবহাটা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার নং- ০৫।র‌্যাবের দায়েরকৃত ওই মামলায় মহাপ্রতারক সাহেদ করিমের সাতক্ষীরা ও ঢাকার ঠিকানা সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও বাচ্চু মাঝির পিতার নাম থেকে শুরু করে থানা ও জেলা সবকিছুই অজ্ঞাত দেখানো হয়।

অন্যদিকে শাঁখরা কোমরপুরের বাচ্চু মাঝি ওরফে সনৎ কুমার মন্ডলের ৯ মাস মৃত্যুর খবরটি ছড়িয়ে পড়লে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিনত কথিত ‘বাচ্চু মাঝি’ নামটি। আর মামলা দায়েরের পর সেই বাচ্চু মাঝিকে সনাক্ত করতে নড়েচড়ে বসে র‌্যাব, ডিবি, থানা পুলিশ প্রশাসনও।চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত ও অনুসন্ধানে মারা যাওয়া ওই বাচ্চু মাঝি ওরফে সনৎ কুমার মন্ডল ছাড়াও আরো দুজন বাচ্চু’র অস্তিত্ব পেয়েছে পুলিশ। যাদের মধ্যে একজন বাচ্চু নিকারী বা বাচ্চু দালাল নামে পরিচিত। তার বাড়ী বাংলাদেশের কোমরপুর ও হাড়দ্দাহ সীমান্তের বিপরীতে ভারতের ২৪ পরগনার সোলাদানা মাঠের পাশে। তার পিতার নাম রাজ্জাক নিকারী। সেখানে জিকে ব্রিকস নামের একটি ইটভাটাও ছিল তার। আর কয়েক বছর আগেও সীমান্ত দিয়ে মানব পাচার ও চোরাচালানের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি। শাখরা গ্রামের ইব্রাহিম গাজী ওই বাচ্চু নিকারী ওরফে বাচ্চু দালালের জামাতা। বর্তমানে সেও থাকে শ্বশুরবাড়ী ভারতের সোলাদানাতে। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, দেবহাটা ও সাতক্ষীরার বড় মাপের ব্যবসায়ী ও বিএনপি নেতার সাথেও বাচ্চু দালালের রয়েছে অতি ঘনিষ্ট সম্পর্ক। তার সাথে সখ্যতা থাকা এসব বড়মাপের ব্যাক্তিদের অধিকাংশরই বাড়ী সাতক্ষীরা শহরে। ফলে সাহেদকে ভারতে পাঠানোর জন্য ভারতের ওই বাচ্চু নিকারী ওরফে বাচ্চু দালালের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সাতক্ষীরার সেসব ব্যাক্তিদের  যোগসুত্র থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়। এছাড়া অপর বাচ্চুর বিষয়ে এখনও তথ্যানুসন্ধান করছে পুলিশ।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দেবহাটা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) উজ্জ্বল কুমার মৈত্র জানান, বাচ্চু মাঝির রহস্য উদঘাটনে এপর্যন্ত তিনজন বাচ্চু’র সন্ধান মিলেছে। যাদের একজন শাঁখরার মনৎ কুমার মন্ডল ওরফে বাচ্চু মাঝি। তিনি মারা গেছেন বলে ইতোমধ্যেই আমরা জানতে পেরেছে। অপরজন ভারতের সোলাদানার বাচ্চু নিকারী ওরফে বাচ্চু দালাল এবং অপরজনের বিষয়ে এখনো অনুসন্ধান চলছে। মুলত তিনজন বাচ্চুর বিষয়টি মাথায় রেখে তদন্ত কার্যক্রম চলছে। তবে ভারতের সোলাদানায় থাকা বাচ্চু দালালের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অধিক গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে ডিবি পুলিশের রিমান্ড শেষে প্রতারক সাহেদকে দেবহাটা থানায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে আনা হবে। আমাদের তদন্ত এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদে নেয়ার পর বাচ্চু মাঝির আসল রহস্য উদঘাটিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)