সোনা মিয়ার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ
১৯৭১ সালের প্রথম দিককার কথা, দিন তারিখ কোনটাই মনে নেই। শুনলাম সাতক্ষীরায় সোনালী ব্যাংক লুট হয়েছে। সে দিনই সাতক্ষীরায় প্রবেশ করল খান সেনারা। প্রথমে তারা আসে থানায় এবং সেখানে এসে তাড়া বেশ কিছু উড়োফায়ার করে। এরপর তারা রাজাকারদের সহায়তায় বর্তমান সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায় এবং তাদের মৃত দেহগুলো পাশের একটি ডোবায় ফেলে দিয়ে মাটি ও পাশে যা কিছু ছিল তা দিয়ে ঢেকে দেয়। একথা শুনে সেখানে আমিও দেখতে গিয়ে দেখি কারো হাত-পা-মাথা ও শরীরের কোন অংশ দেখা যাচ্ছে ময়লা ও মাটির স্তূপের ফাঁক দিয়ে। তা দেখে আমার হৃদয়ের ভেতরটা ভীষণ কষ্টে একবারে অস্থির হয়ে উঠল। সেখান থেকে ফেরার পথে শুনলাম ক্যাপ্টেন কাজী ও তার শ্যালক কে গুলি করে মেরে ফেলেছে পাকিস্তানীরা। ছুটে গেলাম সেখানে; তাদের নিথর দেহ গুলি করা অবস্থায় বে র উপর চিতকাত হয়ে পড়া দুইটি মৃতদেহ। তার আগে খান সেনারা তাদের বাড়ি উড়িয়ে দিয়েছিল।
এছাড়াও শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামীলীগের নেতাদের খুঁজে খুঁজে নির্যাতন ও গুলি করছে তারা। তখন স্টেডিয়ামের পুলের পার্শ্বে আমার একটি দর্জির দোকান ছিল। তার নাম গোল্ড টেইলার্স ছিল। এসময় আমার দোকানের সামনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মিটিং করতো; তা আমি শুনতাম ও ভাবতাম। আর তো বসে থাকা যাবে না; কিছু একটা করতেই হবে। এরমধ্যে হঠাৎ একদিন পাক সেনারা আমার দোকানে এসে হাজির হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত সকলকের ওপর নির্যাতন চালালো; আমার পার্শ্বের দোকানের মালিক সেজো ভাই এর মেঝো ও ছোট ভাইকে বেদাড়ক মারপিট করল তারা। পরের দিন সকালে সেঝো ভাই আমার বাড়িতে আসেন এবং আমার পরিবারকে জানিয়ে যান পাকসেনারা নাকি আমাকে খুঁজছে। তিনি আরও বলে যান- আমি যেন আজ দোকান না খুলি, সেদিন আমার দোকান লুট হয়ে গিয়েছিল। তারপর দোকান খোলা আর হলো না আমার। তখন থেকে সিন্ধান্ত নিলাম মুক্তিযোদ্ধাদের দলে নাম লেখাবো। যেমন ভাবনা তেমন কাজ করার লক্ষ্যে আমার এক দুইজন বন্ধু-বান্ধবের সাথে কথা বললাম; তারাও আমার সাথে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য রাজি হল। এরপর মুতাহার, কাজী কালাম, শহিদুল, নাজমুল, কুদরতি-কু-খুদা সহ আমিও কদমতলাস্থ এসে একত্রিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দলে নাম লেখানোর উদ্দেশ্যে কদমতলা থেকে আবাদের হাট, আবাদের হাট থেকে ভারতের চিতুড়ি সমস্ত রাস্তা হেঁটে যাওয়ায় আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে রাত হওয়ায় সেখানে আমরা রাতে থেকে যায়। পরের দিন সকালে সোনাই নদী পার হয়ে পোঁছালাম হাকিমপুর এবং কয়েকদিন সেখানে ই.পি.আর অধীনে ট্রেনিং গ্রহণ করি আমরা। তখন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা আমাদের আরও ট্রেনিং এর জন্য বিহারে। বিহারে যাওয়ার জন্য প্রথমে ট্রেনে করে কল্যাণিতে একটি ট্রেনিং সেন্টারে পোঁছিয়ে বিকালে কিছু নাস্তা করার পর বাসে ২শ জনকে একসাথে নিয়ে যায় আমরা বিহারে সেখানে একমাস ট্রেনিং করার পর ফিরে আসি কল্যাণিতে। সেখানে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখানোর জন্য এ্যাডমিশন দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ায় সেদিনই আমাদের কে হাকিমপুরে পাঠিয়ে দেয়। হাকিমপুর এসে পোঁছানোর কিছুর সময় পর হাকিমপুর ক্যাম্প ও আশে-পাশের এলাকায় হামলা চালিয়ে অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই পাকসেনারা সেখান থেকে চলে যায়। সে সময় আমাদের কে ই.পি.আর দের সাথে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইটিন্ডিয়া। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর ঘোজাডাঙ্গায় আমরা চলে আসি। নিরাপত্তার সাথে থাকার জন্য ঘোজাডাঙ্গায় আমরাও একটি বাঙ্কার তৈরি করেছিলাম। সেখানে আমরা ৫ দিন অবস্থান করেছিলাম। এবং ৫ দিনই পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের প্রতিহত করতে আমরা সক্ষম হই। এরপর ইটিন্ডিয়া এসেও পাকসেনাদের সাথে আমাদের যুদ্ধ হয়। তখন পাকসেনাদের ওপাশ থেকে কোন গুলির আওয়াজ না পাওয়ায় আমরা কয়েকজন তাদর বাঙ্কারের দিকে এগিয়ে গেলে তারা ই.পি.আর সদস্যদের ওপর গুলি চালায় এবং ই.পি.আর ৫ জন মৃত্যুবরণ করে। তারা হলেন- নজরুল, মালেক, তোফায়েল, তাবারক উল্লাহ ও সিদ্দিক। পরে পাকসেনারা সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর আমরা মৃতদেহগুলো নিয়ে ইটইন্ডিয়ায় আসি; সেখানেই তাদের দাফন করি। ইটিন্ডিয়া ছিল আমাদের প্রধান ক্যাম্প। সেখান থেকে আমাদের সমস্ত কার্যকম আমরা পরিচালনা করি। পরের দিন যুদ্ধের জন্য শাখরার কোমরপুরে যাওয়ার কথা থাকলেও আমরা আমাদের খাওয়ার জন্য ইটিন্ডিয়ায় থেকে গিয়েছিলাম। তারপরে শাখরার কোমরপুরে আমরা পাকিনস্তানীদের ক্যাম্প রেটি করি রাত ১ টা ৩০ মিনিট থেকে ২ টা দিকে। সেখানে দুই গ্রুপের মধ্যে যুদ্ধ চলে প্রায় ১ ঘন্টা। এরপর ভোর রাতে চারদিক যখন স্তব্ধ তখন আমরা নৌকাযোগে ইটিন্ডিয়ায় চলে আসি। ওই দিন রাতেই বৈকারীর ক্যাম্পে অধীনে খলিলনগরে পাকিস্তানী সেনাদের আক্রমণের উদ্দেশ্যে একটি মাইন বসিয়েছিলাম আমরা। সেখানে রাত ১ টার দিকে খান সেনাদের সাথে প্রায় ২ ঘন্টা যুদ্ধ করি আমরা। এরপর আমরা ফিরে যাওয়ার সময় ভেবেছিলাম আমাদের কিছু তার প্রয়োজন। তাই ঘোনার স্কুল থেকে টেলিফোনের তার কেটে নিয়ে আসি এবং সেখানের একটি নির্দিষ্ট স্থানে আমরা একটি মাইন পুতে রেখেছিলাম। পাকিস্থানীদের আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে তার বিপরীতে একটি নিরাপদ আশ্রয়ে গ্রহণ করি। এমন সময় সেখান দিয়ে একজন যাচ্ছিল তাকে ডেকে আমরা জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে। সামনেই পাকিস্তানীরা আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। তাদের কাছেও প্রচুর অস্ত্র রয়েছে। আমরা তার কথা শুনে অস্ত্র ও গুলি নিয়ে সবাই দ্রুত একত্রিত হয়ে রাস্তার নিচের দিকে চলে আসি। কিন্তু সেখানে পাকসেনারা আমাদের ওপর আক্রমণ করেননি। আমরা যখন শিকড়ি স্কুলের সম্মুখে আসার পর পাক সেনারা আমাদের ওপর আক্রমণ করেন। সেখান থেকে কোনো রকম প্রাণে বেঁচে আমরা কৈদুড়ি ক্যাম্প দিয়ে ইটিন্ডিয়ায় চলে আসি। আর পাকিস্থানীরা তাদের মালপত্র নিয়ে সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। যাওয়ার সময় তাদের মালপত্র যে গরুর গাড়িতে ছিল সেটা খলিল নগরের ওই মাইন পোতার জায়গায় পোঁছাতেই আমাদের পুঁতে রাখা মাইনটা ফেটে গিয়েছিল। কিন্তু পাক সেনাদের কোন ক্ষতি হয়নি। তারা সাতক্ষীরায় চলে আসে। আমরা সেসময় বৈকারী, স্কুল, বৈকারি ক্যাম্প, ইউনিয়ন কাউন্সিলের যে সমস্ত জায়গাগুলোতে তারা আশ্রয় নিয়েছিল সেগুলো উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কারণ পরে তারা ফিরে এসে যেন ঐ জায়গাগুরোতে আর আশ্রয় নিতে না পারে এবং ওই দিনেই আমরা ঘোনায় চলে এসে পাকিস্থানীদের সমার্থক সাদেক মাস্টারের বাড়ি উড়িয়ে দিয়েছিলাম। এরপর হঠাৎ ইটিন্ডিয়া থেকে ক্যাপ্টেন মাববুর সাহেব আমাদের ২১ জনের একটি দল তৈরি করে দিয়ে বললেন, তোমাদের যত অস্ত্র-সন্ত্র লাগে নিয়ে যাও। তবে পাকিস্থানীদের হাত থেকে তোমরা সাতক্ষীরা রক্ষা কর। প্রয়োজনে তোমরা জীবন দিয়ে দেবে। কিন্তু ভয় পেয়ে ফিরে আসবে না। হয় মারবে না হয় মরবে। এরপর আমরা সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে ঘোনার একটি বাড়িকে ঘাঁটি বানিয়ে নিয়েছিলাম। সেখান থেকে সাতক্ষীরায় এসে বিভিন্ন অপারেশন করে আবার আমরা আমাদের ঘাঁটিতে ফিরে যেতাম। পাকিবাহিনীরা সাতক্ষীরা শহরের রুহুল আমিন কন্ট্রাকটারের বাড়িতে ক্যাম্প তৈরি করেছিল। সে ক্যাম্পেও তাদের মেজর থাকত। তখন আমরা ভাবলাম, তাদের আস্তানা আগে আমাদের ধ্বংস করতে হবে। সে উদ্দেশ্যে আমরা ঘোনা থেকে সাতক্ষীরাতে এসে রুহুল আমিন কন্ট্রাকটারের বাড়ি উড়িয়ে দেওয়ার জন্য যাই। কিন্তু অতিরিক্ত আলোর কারণে আমরা আমাদের কোন কাজই ঠিকভাবে করতে পারছিলাম না। তার উপর তো ছিল রাজাকারদের পাহারা। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আলোর উৎস্য আগে ধ্বংস করতে হবে। যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। পাওয়ার হাউজের উদ্দেশ্যে চললাম। সেখানে যাওয়ার পর কেউ ভিতরে যেতে সাহস পাচ্ছিলো না। তখন আমি বললাম ঠিক আছে কারোর যাওয়ার প্রয়োজন ঢ়েনই; আমিউ ভিতরে যাবো। আমার সাথে গৌর নামের একজন ছিল। আমরা দুই জন ভিতরে গিয়ে টাইম বোমা ফিট করেছিলাম। এর মধ্যে আমাদের দলের সবাই ভিতরে চলে এসেছিল এবং আমাদের পাহারা দিচ্ছিল। বোমা ফিট করার পর আমরা সবাই দ্রুত সেখান থেকে চলে আসার সময় অনেকগুলো কুকুর আমাদের দেখতে পেয়ে ঘেও ঘেও করতে থাকে। তখন কয়েকজন পাকিস্তানী আনসার আর রাজাকার আমাদের দিকে র্টসলাইট মেরে দেখার চেষ্টা করে। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল; সেদিন তাদের কাছে কোন অস্ত্র ছিল না। আমরা সেখান থেকে পালিয়ে বিডিআর ক্যাম্পের সামনে দিয়ে খুলনা রোডের কাছে যায় তখন বোম দুইটা প্রচন্ড শব্দে ফেটে যায়। আমরা মনে মনে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করি। কিন্তু আমরা সবাই তখন খুবই ক্লান্ত। এমনই ক্লান্ত যে কিছুদুর অর্থাৎ বকচারার রাস্তার পাশেই আসার পর আমরা বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ কানে ছাগলের ডাকের শব্দ শুনতে পেলাম। আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সবাইকে ডেকে তুলে আমরা বিলের ভিতর দিয়ে দত্তডাংগাং গিয়ে সেখানকার মুজিবর মেম্বারের সহয়তায় সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পরের দিন বিকাল বেলা সংবাদ পেলাম আমাদের ক্যাম্প উড়িয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্থানিরা ভাড়–খালি ব্রিজ দিয়ে ঘোনার দিকে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও রওনা হলাম এবং আমরা ২১ জন সবাই ভাড়–খালি খালের পশ্চিম পার্শ্বে পজিশন নিলাম। সেখানে পাকিস্থানি বাহিনীর সদস্যদের সাথে আমাদের প্রায় ২ থেকে ৩ দিন যুদ্ধ চলল। এরপর রেগুলার ফোর্স দিয়ে আমাদের সরিয়ে নেওয়া হলো এবং ঘোনা ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার জন্য আমাদের নির্দেশ দেওয়া হল। আমরাও সেখানে চলে গেলাম। এরই মধ্যে শুনলাম নেবাখালির পুটি নামের একজন লোক নামাজ পড়তে যাচ্ছিল তাকে পাক সেনারা গুলি করে মেরে ফেলেছে। চলে গেলাম সেখানে; তাকে দেখে কষ্টে ভারাক্রান্ত মন অস্থির উয়ে উঠল। এরই মধ্যে পাক সেনাদের অনেক আস্তানা আমরা ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। এবার আমরা ভাবলাম তারা যেন গাড়ি নিয়ে সহজে যাতায়াত করতে না পারে সেজন্য আমাদের কিছু ব্রিজ ধ্বংস করতে হবে। সেই উদ্দেশ্য সফল করতে আমরা খানপুরের ভিতর দিয়ে কুলপোতা ব্রিজের নিকট যেয়ে ব্রিজটি ধ্বংস করি। কিন্তু এই ব্রিজটি ধ্বংস করা আমাদের জন্য খুবই বিপদজনক ছিল। একটু ভুল বা অসাবধনতার কারণে আমাদের সব কিছু শেষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এসব কথা সে সময় কখনো আমাদের ভাবনায় আসিনি। তখন আমাদের ভাবনা একটাই দেশের মানুষকে রক্ষা করতে হবে। দেশকে স্বাধীন করতে হবে। জীবন সেখানে তুচ্ছ। এরই মধ্যে ক্যাপ্টেন মাহবুব সাহেব আমাদের নির্দেশ দিনে আবাদের হাটের পাকিস্থানিদের বাঙ্কার ধ্বংস করতে হবে। তা সফল করতে আমরা শিয়ালডাঙ্গার কাছে একটি ভারী মেশিনগান স্থাপন করলাম এবং সেদিন রাতেই আবাদের হাটের পাকসেনাদের ওপর গুলি চালিয়েছিলাম আমরা। প্রায় কয়েকঘন্টা তাদের সাথে আমাদের যুদ্ধ চলল। এরপরে একসময় দু’পক্ষের গুলি বন্ধ হয়ে যায়। সেদিন রাতের সময় টুকু আমরা ডুমুর তলা নামক এক জায়গায় থাকি এবং সকালে উঠে ঘোনায় চলে যায়। পরবর্তীতে কদমতলার খানসেনাদের বাঙ্কার এবং ব্রিজ ধ্বংস করার জন্য আমাদের ২১জন সহ আরও ৩৫ জনকে দেওয়া হলো আমাদের সাথে। আমরা কদমতলা আক্রমণের জন্য বকচারা থেকে কাশেমপুর পর্যন্ত একটা খালের বেষ্টনি তৈরি করেছিলাম। যখন খান সেনারা আসল তখন সবাইকে আমরা জানিয়ে দিয়েছিলাম; আমরা গুলি করার পর সবাই যেন আক্রমণ শুরু করে। যে কথা সে কাজ। আমরা গুলি শুরু করার পর দুই দিক থেকেই গুলি বিনিময় হয়। তখন আমাদের পক্ষের সবাই মোটামুটি নিরাপদ আশ্রয়ে ছিল। সে সময় আমাদের কারোর কোনো ক্ষতি হয়নি। আমরা কয়েকঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর একজন ই.পি.আর মাওলা আমাদের এসে জানালেন এখানে আর বেশি সময় থাকা ঠিক হবেনা। তার কথা অনুযায়ী আমরা ক্লুলিং করে অর্থাৎ হামাগুড়ি দিয়ে কাশেমপুর স্কুলে আসলাম। সেখানে এসে কাশেমপুর এবং কুচপুকুরের রাস্তায় ২ টি মাইন পুঁতে রেখেছিলাম এবং ওই রাস্তা দিয়ে কখন পাক বাহিনীর সদস্যরা যাবে তা দেখতে সারাদিন পাহারা দিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমে এলেও তারা ওই রাস্তা দিয়ে এলো না; তাই আমরা মাইন ২ টি উঠিয়ে নিয়ে ঘোনার ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হই। পরের দিন শুনলাম তারা ওই রাস্তা দিয়ে আবাদের হাটে যায়। এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা আবাদের হাটে পাকিস্থানিদের আস্তানায় সিরিঞ্জ মটারের সাহায্যে আক্রমণ করবো। সেজন্য আমরা সেখানে যখন গিয়েছিলাম তখন আমাদের সাথে পাকিস্থানিদের তুমূল যুদ্ধ হয়। এক সময় তাদের দিক থেকে গুলি বন্ধ হয়ে গেলো। আমরাও ফিরে এলাম আস্তানায়। পরে জানতে পারলাম তারা আবাদের হাট ছেড়ে চলে গেছে। মেজর জলিল সাহেব এরই মধ্যে আমাদের সাহায্য করতে ক্যাপ্টেন আহসান সাহেবের নেতৃত্বে ৫শ যোদ্ধাকে নিয়ে আসলেন এবং আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জানলেন। এরপর তিনি বিভিন্ন জায়গায় যোদ্ধাদের পাঠিয়ে দিয়ে আমাদের পরানদহে থাকার জন্য নির্দেশ দিলেন। সেদিন তিনিও আমাদের সাথে রাত্রে থাকলেন। ওই দিন গভীর রাতে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রচন্ড শব্দ ভেসে আসছিল। তখন চারদিক কেঁপে উঠছিলো বলে আমাদের মনে হয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম খান সেনারা মনে হয় সাতক্ষীরা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সত্যিই তাই তারা শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় পথের সমস্ত ব্রিজগুলো (কুলিয়া ব্রিজ, বাঁকাল ব্রিজ, কদমতলা ব্রিজ, বিনেরপোতা ব্রিজ, পাটকেলঘাটা ব্রিজ) ধ্বংস করে দিয়ে যায়। যেন পেছন দিক থেকে আমরা তাদের আক্রমণ করতে না পারি। সে দিনটা ছিলো ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ৭ তারিখ। ওই দিনই পাক সেনারা সাতক্ষীরা থেকে চলে যায়। আর তখন থেকে আজও আমরা ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখ কে সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করি।