ভারত-নেপালের বিরোধ চীনের উস্কানিতেই

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং গত ৮ মে যখন ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে চীনের তিব্বত সীমান্তের লিপুলেখের সঙ্গে সংযুক্তকারী ৮০ কিলোমিটার লম্বা একটি রাস্তা উদ্বোধন করেন তখন তিনি হয়তো ধারণাও করেননি যে, এ নিয়ে ভবিষ্যতে প্রতিবেশী নেপালের সঙ্গে এত বড় সংকট তৈরি হবে।

রাস্তাটি উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে নেপাল। দেশটি জানায়, যে এলাকার মধ্য দিয়ে এই রাস্তাটি গেছে, তার অনেকটাই তাদের। কোনো পূর্ব আলোচনা ছাড়াই এই জায়গার ভেতর দিয়ে ভারতের এই রাস্তা তৈরি তারা কখনোই মানবে না।

নেপাল সঙ্গে সঙ্গে ওই অঞ্চলের কাছে তাদের পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করে। কাঠমান্ডুতে ভারতীয় দূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানায়। এরপরও ভারতের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে গত শনিবার নেপালের সংসদের নিম্নকক্ষ দেশের নতুন একটি মানচিত্র অনুমোদন করেছে, যেখানে কালাপানি নামে পরিচিত প্রায় চারশো বর্গ কিলোমিটারের ওই পাহাড়ি এলাকাটিকে তাদের এলাকা বলে দেখানো হয়েছে।

ভোটাভুটিতে নেপালের একজন এমপিও নতুন মানচিত্রের বিপক্ষে ভোট দেননি। এমনকি বরাবর ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত নেপালি কংগ্রেসের এমপিরাও নতুন মানচিত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আর সংসদের বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ভারত বিরোধিতার যে চিত্র নেপালে এখন দেখা যাচ্ছে তা বিরল।

বিস্মিত ভারতের আঙুল চীনের দিকে

ঐতিহাসিকভাবে অনুগত ক্ষুদ্র এই প্রতিবেশীর এসব প্রতিক্রিয়ায় ভারতে একাধারে বিস্ময় এবং উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ভারতে অনেকের কাছে প্রশ্ন হচ্ছে – ‘এত বড় পদক্ষেপ কেন এখন নেপাল নিচ্ছে? সড়কটি তো রাতারাতি তৈরি হয়নি, নেপাল তো অনেকদিন ধরেই দেখছে যে ভারত সড়কটি তৈরি করছে।’

ভারতের সেনাপ্রধান এম এম নারাভানে। তিনি বলেন, তৃতীয় একটি দেশ নেপালকে উসকে দিচ্ছে

ভারতের সেনাপ্রধান এম এম নারাভানে। তিনি বলেন, তৃতীয় একটি দেশ নেপালকে উসকে দিচ্ছে

ভারতের সেনাপ্রধান এম এম নারাভানে তো সরাসরি বলেই ফেলেছেন যে, তৃতীয় একটি দেশ হয়তো নেপালকে উস্কে দিয়েছে। চীনের দিকে আঙুল নির্দেশ করেছেন তিনি। ভারতে অনেক পর্যবেক্ষকও একইরকম সন্দেহ করছেন।

দিল্লিতে বিবিসি বাংলার প্রতিনিধি বলছেন, ভারতের সরকার মুখে বলছে না ঠিকই, কিন্তু নেপালের সঙ্গে এই সঙ্কটের পেছনে নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি চীনের ইন্ধন নিয়েও তারা গভীরভাবে সন্দিহান।

চীন কি আসলেই এই বিরোধে আগুন দিচ্ছে?

নেপালকে কি কেউ উসকাচ্ছে?-সে সম্ভাবনাও শতভাগ উড়িয়ে দিচ্ছেন না যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক কনস্টানটিনো হাভিয়ের।

প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ একটি প্রকাশনায় এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, যদিও নেপাল দাবি করে যে, তারা ৯০-এর দশক থেকে বিতর্কিত এলাকাটির সমাধান নিয়ে ভারতের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, চীন কাঠমান্ডুকে বিষয়টি নিয়ে তাদের অবস্থান শক্ত করতে পরোক্ষভাবে হলেও উৎসাহিত করছে না।

তিনি বলেন, তারপরও প্রধানমন্ত্রী অলিকে এখনই ‘চীনপন্থী’ বলে আখ্যা দেয়া সঙ্গত হবে না এবং চীন আ-দৌ পেছন থেকে কোনো কলকাঠি নাড়ছে কি-না তার কোনো প্রমাণ এখনো নেই।

চীন এখনো পর্যন্ত তাদের তিব্বত সীমান্তে ‘কালাপানি-লিপুলেখ-লিঙ্গুয়াধারা’ অঞ্চল নিয়ে নেপাল-ভারত বিরোধ নিয়ে কোনো কথা বলেনি।

ভারতের সাবেক কূটনীতিক দেব মুখার্জি, যিনি ২০০০ সাল থেকে দুই বছর কাঠমান্ডুতে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, এখনই এই বিরোধে চীনের সম্ভাব্য ইন্ধনের প্রসঙ্গ তুলতে রাজি নন।

তিনি বলেন, এটা ঠিক যে হঠাৎ করে মানচিত্র বদলে ফেলার মতো এত বড় পদক্ষেপ কেন নেপাল নিল তা বোঝা মুশকিল। কিন্তু ভারতে অনেকেই যে এটাকে চীনের উস্কানি হিসেবে দেখছেন আমি তার সঙ্গে একমত নই।

তার মতে, এই এলাকার মালিকানা নিয়ে ভারত ও নেপালের মধ্যে ঐতিহাসিক বিতর্ক থাকলেও চীন অনেকদিন ধরেই মেনে নিয়েছে এটি ভারতের এলাকা।

তিনি বলেন, ১৯৫৪ সালে চীন ও ভারতের মধ্যে যে ‘ঐতিহাসিক এক বাণিজ্য চুক্তি হয়, তাতে এই অঞ্চলকে চীন কার্যত ভারতের অংশ বলে মেনে নেয়। ১৯৯৬ সাল থেকে লিপুলেখ দিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে নতুন করে বাণিজ্য শুরু হয়, যা এখনো চলছে।

নেপালের এই প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে প্রধানত তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সম্পর্ক দেখছেন সাবেক এই ভারতীয় কূটনীতিক।

তিনি বলেন, বর্তমানে যারা নেপালে ক্ষমতায় রয়েছেন, তারা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পথ নিচ্ছেন এবং জাতীয়তাবাদ বা সার্বভৌমত্বের কথা তুললেই সবাই এক হয়ে যায়।

কী বলছে নেপাল

তবে কালাপানির মালিকানা নিয়ে ভারত ও নেপালের বিরোধ হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়নি। এ বিষয়ে নেপালের ভাষ্য, তারা ৯০-এর দশক থেকেই ভারতের কাছে এই এলাকাটি নিয়ে কথা বলতে চাইছে। এমনকি ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেপাল সফরের সময়েও এটি তারা আলোচনার এজেন্ডায় রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু ভারত সবসময় তা পাশ কাটিয়ে গেছে।

নেপাল দাবি করে, ১৮১৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে এক চুক্তি অনুযায়ী কালি নদীর পূর্বাঞ্চল তাদের। কিন্তু ভারত সবসময় কালি নদীর উৎস এবং তার নদীর প্রবাহ বদলে যাওয়াসহ ওই অঞ্চলের ওপর তাদের অধিকার নিয়ে নানা প্রমাণ হাজির করেছে। তাছাড়া, ভারত গত ৬০ বছর ধরেই এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানে তাদের সেনা মোতায়েন রয়েছে। বহু অবকাঠামো তৈরি করেছে তারা।

হিমালয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে গবেষণাধর্মী একটি বই লিখেছেন কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী।

নেপালের পার্লামেন্টে নতুন মানচিত্র তৈরির প্রস্তাবে ভোট দিচ্ছেন এমপিরা

নেপালের পার্লামেন্টে নতুন মানচিত্র তৈরির প্রস্তাবে ভোট দিচ্ছেন এমপিরা

তিনি বলছেন, লিপুলেখ সীমান্ত এলাকা নিয়ে ভারত ও নেপালের এই নজিরবিহীন বিরোধের পেছনে নেপালে রাজতন্ত্র পরবর্তী রাজনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ভারতকে চ্যালেঞ্জ করে যেভাবে তারা মানচিত্র বদলের পথে গেছে, সেটা যেন অনেকটা ‘ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স’। স্বাধীনতার ঘোষণার মতো।

ড. আলীর মতে, ভারতের সঙ্গে তাদের দেশের নতজানু ধরনের সম্পর্ক নিয়ে এবং ভারত লাগোয়া তরাই সমতলে বিহার এবং উত্তরপ্রদেশ থেকে বিপুল সংখ্যায় ভারতীয়দের অভিবাসন নিয়ে পাহাড়ি নেপালিদের মধ্যে সবসময়ই ক্ষোভ ছিল। তিনি বলেন, রাজতন্ত্রের পতন এবং চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে নেপালিরা এখন হয়তো ভারতের বিরুদ্ধাচরণ করার শক্তি পাচ্ছেন।

ভারত সবসময় নেপালকে তাদের এবং চীনের মধ্যে একটি বাফার হিসেবে দেখতো। ফলে চীনের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক যত বাড়ছে, ভারতের মধ্যে নেপালকে নিয়ে উদ্বেগ তত বাড়ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সময়ে সময়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নাখোশ হয়ে নেপালকে শায়েস্তা করতে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের আমদানির ওপর সীমান্তে বাধা তৈরি করছে ভারত। পর্যবেক্ষকদের মতে, এ কারণে নেপালিদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব আরও চাঙ্গা হয়েছে এবং তা প্রকাশ করতে তারা এখন আর দ্বিধা করছে না।

ড. আলী মনে করেন, চীন সরাসারি এই বিরোধ তৈরি করছে না। কিন্তু নেপালিরা হয়তো মনে করছে যে, তাদের এখন ভারতের বিরোধিতা করার ক্ষমতা হয়েছে। কারণ তারা চীনের সমর্থন পাবে।

ভারত এখন কী করবে?

বিবিসি বাংলার নয়াদিল্লি প্রতিনিধি বলছেন, ভারত এখন বিষয়টিকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করার কৌশল নিয়েছে। ভারত এখন এ নিয়ে নেপালের সঙ্গে কথা বলতেই রাজি নয়। দিল্লিতে নেপালের রাষ্ট্রদূত গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাতে কোনো সাড়াই দিচ্ছেন না।

চীনের সঙ্গে সীমান্তে সামরিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে, বাণিজ্যিক দিক দিয়ে গুরুত্বের বিবেচনায় এবং এর ধর্মীয় দিক থেকে প্রতীকী গুরুত্ব বিবেচনা করে ভারত হয়তো কখনোই এলাকার ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ ছাড়বে না।

কিন্তু কনস্টানটিনো হাভিয়ের লিখেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারতকে এই সমস্যা সমাধান করতে হবে। তা নাহলে চীন একটা সময় এখানে নাক গলাতেই পারে। এখন পর্যন্ত চীন চুপ, কিন্তু ভবিষ্যতে হিসাব বদলে যেতেই পারে। কালাপানি নিয়ে বিরোধ ২০১৭ সালের ভুটান সীমান্তে ডোকলাম সংকটের রূপ নিতেই পারে।

২০১৭ সালে ডোকলামে রাস্তা নির্মাণ নিয়ে ভুটান এবং চীনের মধ্যে বিরোধ শুরু হরে ভারত সেখানে গিয়ে সৈন্য মোতায়েন করে।

ড মাহমুদ আলীও মনে করেন, কালাপানির মালিকানা নিয়ে চীন হয়তো কখনোই সরাসরি মাথা গলাবে না। কিন্তু পেছন থেকে নেপালকে কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমর্থন জোগাতেই পারে।

হাভিয়ের বলছেন, এলাকার ওপর দুই দেশের যৌথ সার্বভৌমত্ব বা এলাকার যৌথ ব্যবস্থাপনা সংকট সমাধানের একটি সম্ভাব্য পথ হতে পারে। কিন্তু দুটি দেশেই যে ধরনের কট্টর জাতীয়তাবাদী দুই সরকার এখন ক্ষমতায়, আলোচনা কখনো হলেও সে ধরনের প্রস্তাব হয়তো টেবিলেই আসবে না।

সাবেক কূটনীতিক দেব মুখার্জি বলছেন, ব্যাপারটির সমাধান এখন সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)