করোনায় তীব্র ক্ষতির মুখে দেবহাটার হাট-বাজার: লক্ষ লক্ষ টাকা লোকসানের আশংকা
বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের কারনে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তীব্র ক্ষতির মুখে পড়েছেন সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার প্রায় পনেরটি হাটবাজারের বৈধ ইজারাদাররা। বাজার ইজারা নেয়ার পরপরই করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে টানা দুই মাসের অধিক সরকারি ছুটি ঘোষনা ও লকডাউনের কারনে উপজেলার হাট গুলো বন্ধ ঘোষনা এবং অন্যান্য বাজারগুলো কখনো বন্ধ, কখনো চালুসহ একাধিকবার বিভিন্ন মাঠে ময়দানে স্থানান্তর অর্থাৎ ভাসমান প্রক্রিয়ায় সীমিত কার্যক্রম চলায় অধিকাংশ বাজার গুলোতে এবছর লক্ষ লক্ষ টাকা লোকসানের আশংকা করছেন ইজারাদাররা।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি বছরের ফ্রেব্রুয়ারীর মাঝামাঝিতে দেবহাটা উপজেলার অভ্যন্তরীন প্রায় পনেরোটি হাটবাজার ইজারা প্রদানের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশসহ দরপত্র বিক্রি শুরু করে দেবহাটা উপজেলা প্রশাসন। বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক এসকল বাজারের জন্য সরকার নির্ধারিত মুল্যে দরপত্র সংগ্রহ ও ব্যাংক ড্রাফট জামানত রেখে দরপত্র দাখিল করেন উপজেলার প্রায় ৩০ জন ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠান। গত ৪ মার্চ দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে হাট বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নির্বাহী অফিসার সাজিয়া আফরীনসহ সকল সদস্যদের উপস্থিতিতে দাখিলকৃত দরপত্র গুলো যাচাই বাছাই শেষে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে একসাথে ১৩টি বাজারের ইজারা প্রদান করা হয়।
এসকল হাট বাজারের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে চলতি বাংলা ১৪২৭ সনের জন্য (১ বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্র পর্যন্ত) পারুলিয়া পশুহাটটি মূল ৭০ লক্ষ ৭৭ হাজার টাকা এবং ভ্যাটসহ ৯২ লক্ষ টাকায় ইজারা নেন জেলা পরিষদ সদস্য আলহাজ্ব আলফেরদাউস আলফা। কুলিয়া নতুন বাজারটি মুল ২ লক্ষ ৬ হাজার ১শত টাকা এবং ভ্যাটসহ ২লক্ষ ৫৭ হাজার টাকায় ইজারা গ্রহন করেন দেবহাটা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান শাওন। একই সাথে মাহমুদুল হাসান শাওন কুলিয়া রেণু ও মৎস্য সেডটি মুল ২ লক্ষ ৮৩ হাজার ১৯০ টাকায় এবং ভ্যাটসহ প্রায় ৩ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকায় ইজারা গ্রহন করেন। পারুলিয়া মৎস্য সেডটি মুল ৩৭ হাজার টাকায় এবং ভ্যাটসহ ৪৬ হাজার ২৫০ টাকায় ইজারা গ্রহন করেন উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান মিন্নুর, সখিপুর বাজারটি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সুমন মুল ৫ লক্ষ টাকায় এবং ভ্যাটসহ ৬ লক্ষ ২৫ হাজার টাকায় ইজারা গ্রহন করেন। ঈদগাহ বাজারটি সাংবাদিক মোমিনুর রহমান মুল ১ লক্ষ ৯৩ হাজার ২৩০ টাকায় এবং ভ্যাটসহ ২ লক্ষ ৪১ হাজার ৫শ টাকায় ইজারা গ্রহন করেন। গাজীরহাট বাজারটি আনন্দ মোহন সরকার মুল সাড়ে ৩ লক্ষ টাকায় এবং ভ্যাটসহ ৪ লক্ষ ৩৭ হাজার টাকায় ইজারা গ্রহন করেন। সুবর্ণাবাদ বাজারটি সাংবাদিক আজিজুল হক আরিফ মূল ২১ হাজার ৩শ টাকায় এবং ভ্যাটসহ ২৬ হাজার ৬শ টাকায় ইজারা গ্রহন করেন। দেবহাটা বাজারটি স্থানীয় শফিকুল ইসলাম মুল ৪০ হাজার টাকায় এবং ভ্যাটসহ ৫০ হাজার টাকায় ইজারা গ্রহন করেন। এছাড়া ক্ষুদ্র বাজার গুলোর মধ্যে নাংলা বাজারটি হাবিবুর রহমান, টাউনশ্রীপুর বাজারটি ইয়াকুব আলী এবং পরবর্তীতে বহেরা বাজারটি আবু হুরাইরা ইজারা গ্রহন করেন।
বাজারগুলো ইজারা গ্রহনের পরপরই শুরু হয় মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রকোপ। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে গত ২১ ও ২২ মার্চ সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল ফেসবুক আইডিতে দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে জেলার অভ্যন্তরীন পশুহাটসহ সকল হাট পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষনা করেন। যেকারনে পুরোপুরি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় দেবহাটা উপজেলার সর্ববৃহৎ পারুলিয়া পশুহাট এবং ঈদগাহ হাটের যাবতীয় কার্যক্রম। আর টানা প্রায় দুই মাসেরও অধিক সময় ধরে সরকারী ছুটি ও লকডাউন ঘোষনাসহ উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের নির্দেশে একাধিকবার বিভিন্ন মাঠে ময়দানে স্থানান্তরের মাধ্যমে ভাসমান অবস্থায় সীমিত আকারে কার্যক্রম চলতে থাকে দেবহাটা উপজেলার অন্যান্য বাজারগুলোতে।
এতে করে একদিকে লকডাউন, সরকারী ছুটি ও বারবার এক স্থান থেকে অন্যস্থানে বাজার স্থানান্তর এবং অপরদিকে মহামারী করোনা ভাইরাসের কারনে বাজারে ক্রেতা বিক্রেতার সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কমতে থাকায় বর্তমানে তীব্র ক্ষতির মুখে পড়েছেন এসকল বাজারের ইজারাদাররা। যার ফলে ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে অধিকাংশ ইজারাদাররা এসকল হাট বাজার ইজারা গ্রহন করে এবছর দ্বিমুখী যন্ত্রনা ও বিড়ম্বনাসহ লাখ লাখ টাকা লোকসানের আশংকায় দিন কাটাচ্ছেন। এমনকি এপর্যন্ত ভ্যাটসহ মুল ইজারার অর্ধেকের বেশি টাকা টাকা সরকারী কোষাগারে জমা দিয়ে লিখিত আবেদনের মাধ্যমে সময় প্রার্থনা করেও বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের চাপাচাপি থেকে রেহাই পাচ্ছেননা উপজেলার গুরুত্বপূর্ন ও বড়বড় বাজার গুলোর ইজারাদাররা।
পারুলিয়া পশুহাটের ইজারাদার ও সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের সদস্য আলহাজ্ব আল ফেরদাউস আলফা জানান, এবছরে পারুলিয়া পশুহাটটি ভ্যাটসহ মোট ৯২ লক্ষ টাকায় উপজেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইজারা গ্রহন করেছেন তিনি। বিগত বছরেও ওই পশুহাটটির ইজারা নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এবার ইজারা নেয়ার পরপরই করোনা পরিস্থিতির জন্য তার হাটটির কার্যক্রম প্রশাসনিকভাবে বন্ধ ঘোষনা করায় বাংলা ১৪২৬ সালের শেষের দিকে ৮ টি এবং ১৪২৭ সালের শুরুতে ৭ টি মিলিয়ে মোট ১৫টি হাটের কোন কার্যক্রম পরিচালনা এবং খাজনা আদায় করতে পারেননি তিনি। এছাড়া পারুলিয়া পশু হাটের প্রত্যেকটি হাটে নিয়ন্ত্রনের জন্য তার প্রায় ৪৫ জন বেতনভুক্ত শ্রমিক কাজ করেন। হাট বন্ধ থাকলেও ওই শ্রমিকদের বেতনের টাকা পকেট থেকেই গুনতে হয়েছে তাকে। সবমিলিয়ে পশুহাট বন্ধ থাকার কারনে এপর্যন্ত তার প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিসাধন হয়েছে। এছাড়া করোনা পরিস্থিতির কারনে অদ্যবধি জেলার বাইরের ব্যবসায়ীরা হাটে আসছেন না। আর ক্রেতার সংখ্যাও অন্যান্য বছরের থেকে উদ্বেগজনক কম। ফলে এভাবে চলতে থাকলে বছর শেষে অর্ধকোটি টাকারও বেশি লোকসান গুনতে হবে। তিনি আরো বলেন, এপর্যন্ত তিনি মোট ৪৫ লক্ষ টাকা উপজেলা প্রশাসনের কাছে জমা দিয়ে বাকি টাকা পরিশোধের জন্য সময় চেয়ে লিখিত আবেদন করেছেন তিনি। তবুও হাট বাজার ইজারাদারদের দুরবস্থা চলা স্বত্ত্বেও বিভিন্ন সময়ে এককালীন সমুদয় টাকা পরিশোধের জন্য তিনিসহ অন্যান্য ইজারাদারদের চাপপ্রয়োগ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করে আলফা বলেন, শুধু পারুলিয়া পশু হাট নয়, জেলার মধ্যে অন্যতম বৃহৎ বিনেরপোতা হাটটিও ১ কোটি ১৫ লক্ষ টাকায় ইজারা নিয়েছি। সেখানেও ৪৫ লক্ষ টাকা জমা দিয়ে সময় প্রার্থনা করলে বাকি টাকা প্রতি মাসে জমা দেয়ায় সুবিধা পেয়েছি কিন্তু দেবহাটা উপজেলাতে ইজারাদারদের লোকসানের বিষয়টি বিবেচনা করে মানবিক সহানুভুতি দেখাতেও উপজেলা প্রশাসন সংকোচ বোধ করছেন। সম্প্রতি আমাকে টাকা পরিশোধের জন্য চাপসৃষ্টি করলে আমি ২০ লক্ষ টাকার পে-অর্ডার উপজেলা প্রশাসনের কাছে জমা দিয়ে এক মাসের সময় চেয়েছি। যেহেতু এবছর হাটবাজার ইজারা নিয়ে সকল ইজারাদাররা তীব্র লোকসানের মুখে পড়েছেন, সেহেতু মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে প্রত্যেকটি হাটবাজারের সরকার নির্ধারিত মুল্যে ইজারা নির্ধারণ অথবা করোনা পরিস্থিতির জন্য লকডাউন, হাটবাজার বন্ধ ও কার্যক্রম সীমিত ঘোষনা এবং বাজার একাধিকবার স্থানান্তর তথা ভাসমান হিসেবে পরিচালিত হওয়ায় ইজারাদাররা এবছর যে পরিমান আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তা ক্ষতিপুরণের জন্য সকল ইজারাদারদের পক্ষে দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাজিয়া আফরীন ও সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামালের কাছে দাবী জানিয়েছেন জেলা পরিষদ সদস্য আলহাজ্ব আল ফেরদাউস আলফা।