যেদিন প্রথম গোল করেছিলেন মেসি
বাঁ পায়ে বল নিয়ে দৌড়াচ্ছেন মধ্যম গড়নের এক ফুটবলার। সামনে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রা এগিয়ে আসছেন, তবে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। কিভাবে যেনো খুব সহজেই তাদের বোকা বানিয়ে এগিয়ে গেলেন ফুটবলারটি। সামনে গোলকিপার, শট করলেই গোল। কিন্তু না, এতো সহজে লক্ষ্যভেদ করলে চলে? তাই গোলকিপারকেও নাচালেন। নাচালেন প্রতিপক্ষকে। এরপরই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত, গোওওওওল!
আবার খেলা চলছে। ডি-বক্সের একটু বাইরে প্রতিপক্ষের ফাউলের স্বীকার হয়েছেন কোনো সতীর্থ। মধ্যম আকৃতির ফুটবলারটি বলের কাছে এগিয়ে এলেন, নিচু হয়ে মোজা ঠিক করে কিছুটা পিছিয়ে শটের প্রস্তুতি নিলেন। বাজপাখির চোখে শেষবারের মতো দেখে নিলেন গোলকিপার ও রক্ষণের খেলোয়াড়দের পজিশন। রেফারি বাঁশি বাজানোর পর ধীর পদক্ষেপে শুরু করে কিছুটা জোরের ওপর হাওয়ায় ভাসিয়ে শট এবং গোলবারের কোণা দিয়ে বল সোজা জালে। আবারো গোল…
কার কথা বলা হচ্ছে, এতক্ষণে হয়তো নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন সবাই। ফুটবল মাঠে এভাবে একে একে অসংখ্য গোলের পসরা সাজিয়েছেন আর্জেন্টাইন সুপারস্টার লিওনেল মেসি। ক্লাব বা জাতীয় দলের হয়ে হরহামেশাই গোল করে যান এই ফরোয়ার্ড।
স্প্যানিশ লা লিগায় ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার হয়ে ২০০৪-০৫ মৌসুমে মেসির অভিষেক হয়। সেই শুরু থেকেই একেরপর এক গোল করে যাচ্ছেন তিনি। লক্ষ্যভেদ করা যেনো তার কাছে শ্বাস প্রশ্বাস নেয়ার মতোই স্বাভাবিক এক ঘটনা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য রেকর্ড গড়েছেন ‘দ্য গোট’।
চলতি মৌসুমে ২৯ গোলসহ ক্যারিয়ারে দেশ ও ক্লাবের হয়ে সবমিলিয়ে ৭০০টিরও বেশি গোল করেছেন মেসি। তবে এরপরও কমেনি তার গোল ক্ষুধা। এই মহাতারকার গোলবন্যার যাত্রা শুরু হয়েছিল আজ থেকে ঠিক ১৫ বছর আগে, ২০০৫ সালের ১ মে। এদিন বার্সেলোনার ঘরের মাঠ ন্যু ক্যাম্পে আলবাসেতের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো লক্ষ্যভেদ করেন তিনি।
স্পেনের ফুটবল লিগ লা লিগায় সে সময় শিরোপার জন্য বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের ভেতর চলছিল তুমুল লড়াই। অবস্থা এমন যে একটা ম্যাচ পা হড়কালেই শিরোপার লড়াই থেকে ছিটকে যাবে দুই দলের যে কেউ। এমন সময় ১ মে রেলিগেশন জোনে থাকা আলবাসেতের বিপক্ষে খেলতে নামে বার্সা। অনেকেই ভেবেছিল খুব সহজে হেসে খেলেই ম্যাচটি জিতবে স্বাগতিকরা।
তবে ধারণাটি খুব শিগগিরই ভুল প্রমাণ করে আলবাসেত। যদিও ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ২-০ ব্যবধানে জিতেছিল বার্সেলোনা। তবে শেষ মুহূর্তে জয়সূচক গোল করে সেদিন স্প্যানিশ জায়ান্টদের বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন ছোট্ট মেসিই, যা ছিল পেশাদার ক্যারিয়ারে তার প্রথম গোল।
আলবাসেতের বিপক্ষে ম্যাচের প্রথম গোলটি করেছিলেন ক্যামেরুনের স্ট্রাইকার স্যামুয়েল ইতো। ম্যাচের তিন মিনিট বাকি থাকতে তাকে তুলে নিয়ে মেসিকে নামান বার্সেলোনার সেসময়ের কোচ ফ্র্যাংক রাইকার্ড। ডাগআউটে ফেরার আগে মেসিকে ছোট্ট একটি কথা বলেছিলেন ইতো। লা লিগাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমি মেসিকে বলেছিলাম সুযোগকে গোলে পরিণত করার চেষ্টা করবে। সম্ভাব্য প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগাবে। যেদিন থেকে গোল করা শুরু করবে, আর কখনো তুমি থামবে না।
রেকর্ড ছয়বার ব্যালন ডি’অর জয়ী মেসি এখনো সেই কথা মেনে চলেন জানিয়ে ইতো আরো বলেন, মেসি এখনো আমার উপদেশটি স্বীকার করে এবং সম্প্রতি বলেছে আমার এই উপদেশই তার ক্যারিয়ার পরিবর্তন করে দিয়েছে। সত্য বলতে সে এখনো আগের মতোই আছে। মেসি এখনো তেমনই ভালো মানুষ হিসেবে আছে যেমনটা আমি তাকে দেখেছিলাম।
সাবেক বার্সা স্ট্রাইকার আরো যোগ করেন, যখন থেকে মেসি বার্সেলোনার বি দল থেকে মূল দলে আসে আমরা তখন থেকেই জানতাম সে কতটা দুর্দান্ত। তাকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হয়েছে তবে তার ভেতর সবসময় প্রতিভা ছিল যা আলবাসেতের বিপক্ষে ম্যাচে দেখা যায়।
১ মে’র সেই ম্যাচে ১-০ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকলেও বার্সেলোনাকে বেশ ভালোভাবে চাপে রেখেছিল আলবাসেত। নিজেদের অতিরিক্ত রক্ষণের পাশাপাশি কাউন্টার অ্যাটাকভিত্তিক খেলা দিয়ে ক্রমেই ম্যাচ আয়ত্তে আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো সফরকারী দলটি। অবস্থা এমন যে স্ট্রাইকার রোনালদিনহো, মিডফিল্ডার আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা ও ডেকো নিজেদের ছায়া হয়ে ছিলেন। এমন সময়ে মেসিকে নামান রাইকার্ড। গুইলেম বালাগ সম্পাদিত মেসির বায়োগ্রাফিতে এমন মুহূর্তে মেসিকে নামানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তৎকালীন বার্সা কোচ বলেন, আমাদের মনে হয়েছিল মেসির মতো উঠতি তরুণদের পরীক্ষা করার এটা দারুণ একটা সুযোগ।
মেসিকে নামানোর মুহূর্তে ক্যাম্প ন্যুতে একটি ‘বিরাট কিন্তু ঠাণ্ডা কড়াই’- এর মতো পরিবেশ বিরাজ করছিল। এই ম্যাচের আগে বার্সা মূল দলের হয়ে সর্বসাকুল্যে পাঁচটি লা লিগা ও একটি করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও কাপ ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল মেসির, ফলে তখনো পাদপ্রদীপের আলোয় আসেননি তিনি।
তবে এই ম্যাচে নামার দেড় মিনিটের মাঝেই পুরো গ্যালারিকে আনন্দে ভাসান মেসি। রোনালদিনহোর ‘ইঞ্চি-পারফেক্ট’ পাস থেকে আলবাসেতের গোলকিপার রাউল ভালবিউনাকে বোকা বানিয়ে চিপ করে গোল করেন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। তবে গ্যালারি পুনরায় নিস্তব্ধ হতে সময় লাগেনি, কারণ গোলটি বিতর্কিতভাবে অফসাইড ধরেন রেফারি।
যেকোনো তরুণ ফুটবলারের জন্যই এমন মুহূর্ত হতাশার। বিষণ্ন মেসির কাছে এসময় রোনালদিনহো এগিয়ে এসে বলেন, আমি আবার তোমাকে বল দেবো।
কাকতালীয়ভাবে পূর্বের ঘটনার মাত্র ৯০ সেকেন্ডের মাথায় ব্রাজিলিয়ান এই তারকা আলবাসেতের রক্ষণভাগকে বোকা বানিয়ে ফাঁকায় থাকা মেসিকে বল এগিয়ে দেন।
যথেষ্ট সময় ও জায়গা থাকায় বল একবার বাউন্স করে নিয়ে ধেয়ে আসা ভালবিউনাকে বোকা বানিয়ে বাঁ পায়ে দারুণ স্কুপের মাধ্যমে লক্ষ্যভেদ করেন মেসি। এরপর তার বিখ্যাত সেলিব্রেশন দুই হাত ছড়িয়ে দৌড় দেন তিনি। সিনিয়র লেভেলে প্রথম এই গোল করার আনন্দে রোনালদিনহোর ঘাড়ে উঠে বসেন মেসি। উল্লাসে ফেটে পড়া ৯১ হাজার দর্শকও সেদিন বুঝতে পারে, ছেলেটির ভেতর কিছু আছে।
মেসির উঠে আসার বিষয়ে ইতো বলেন, আমার জন্য মেসির খেলার ধরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে কখনো কাউকে চাপে ফেলতো না। আমরা এখন জানি যে মেসি বর্তমানে যে জায়গায় আছে কখনো না কখনো সে এমন হতোই। আমি খুবই খুশি যে সে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে সঠিক জায়গায় নিয়ে এসেছে। আমি তার খেলার গল্পে মুগ্ধ ও গর্বিত। এটা অবশ্যই এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
মেসির প্রথম এই গোলের মাধ্যমে রোনালদিনহোর সঙ্গে তার সম্পর্কটা আরো মজবুত হয়ে ওঠে। মেসির বায়োগ্রাফিতে এই ব্রাজিলিয়ান তারকা সেই মুহূর্ত স্মরণ করে বলেছেন, মেসির প্রথম গোল বাতিল হওয়ার পর আমি চাইনি সে শূন্য হাতে ফিরুক। আমি ওকে বলে দেই যে আবার গোল করার জন্য আমি তোমায় পাস দেবো। কাল শিরোনামে তুমিই থাকবে।
রোনালদিনহোর কথাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়। এখন রোনালদিনহো খেলছেন না, কিন্তু এখনো আছেন মেসি। এখনো নিয়মিত শিরোনামে আছেন বার্সা মহাতারকা।
সেই গোলের পর বহু শিরোপা জিতেছেন, বহু পুরস্কার পেয়েছেন লিওনেল মেসি। অনেক ফুটবলবোদ্ধা ও ভক্ত সমর্থকের মতে সর্বকালের সেরা ফুটবলার মেসিই। ‘দ্য গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’ ভবিষ্যতেও গোল করবেন, আনন্দে ভাসাবেন সমর্থকদের। তবে বার্সেলোনার হয়ে প্রথম করা গোলটি নিশ্চয় তিনি ভুলবেন না কখনো।