সাতক্ষীরায় নেই করোনা পরীক্ষাগার, ভোগান্তিতে রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীরা

সাতক্ষীরায় করোনা পরীক্ষাগার স্থাপন না হওয়ায় ভোগান্তিতে রোগীর স্বজন ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে সচেতন সাতক্ষীরাবাসীর মধ্যেও। অন্যদিকে, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) মেশিন স্থাপনের মতো উপযোগী পরিবেশ থাকার স্বত্ত্বেও স্বাস্থ্য বিভাগের এক প্রকারের উদাসীনতার জন্য তা আলোর মুখ দেখছে না বলে অভিযোগ করেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

জানা যায়, সারাদেশের তুলনায় সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরায় করোনার ঝুঁকিতে আতঙ্কিত বেশি মানুষ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে করোনা আক্রান্ত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, শরিয়তপুর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ সহ বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক, বিদেশ ফেরত বৈধ্য ও অবৈধ্যপথে প্রায় ১৪ হাজার প্রবাসী সাতক্ষীরায় অবস্থান করছেন। ইতোমধ্যে করোনার উপস্বর্গ সন্দেহে ৩১৯ জনের স্যাম্পল গ্রহণ করে খুলনা মেডিকেল কলেজে পাঠিয়েছে জেলার কর্মরত চিকিৎসকরা। একই সঙ্গে করোনা উপস্বর্গে জেলায় দিন দিন বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। সর্বশেষ, গত কয়েকদিন আগে করোনা আক্রান্ত হয়ে বাইরের জেলা থেকে ২ জন ব্যক্তি সাতক্ষীরার বাড়িতে অবস্থান করেছেন। এছাড়াও উপসর্গ নিয়ে গতকাল জেলায় আরও এক ব্যক্তি মারা যায়। এমন পরিস্থিতিতেও সাতক্ষীরায় নেই করোনা পরীক্ষাগার। ফলে ভোগান্তিতে রোগীর স্বজন ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনা করে সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটি, নাগরিক আন্দোলন ম ও সাতক্ষীরা নাগরিক অধিকার উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সংগঠকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা জেলায় করোনা পরীক্ষাগার স্থাপনের দাবি করলেও করোনা পরীক্ষাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ; তারই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দাবির পাশাপশি সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন সাতক্ষীরা-০১ (তালা-কলারোয়া) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ। ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, গত দুই সপ্তাহ নারায়নগঞ্জ, ঢাকা, গাজীপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ করোনা আক্রান্ত বিভিন্ন জেলা থেকে সড়ক ও নৌপথে প্রায় ২০ হাজার এর বেশি শ্রমজীবী ওই সকল জেলার লকডাউন উপেক্ষা করে সাতক্ষীরা জেলায় ফিরে এসেছে এবং করোনা আক্রান্ত বিভিন্ন জেলা থেকে সাতক্ষীরায় আসা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ জেলায় ফিরে আসাতে জেলাবাসী শঙ্কিত। সাতক্ষীরা জেলায় এখনও পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত জেলা থেকে বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ আসার ফলে এখানে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি প্রবল। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাসে করোনা সনাক্তকরণ কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং সনাক্তকৃত রোগীদের আইসোলেসনে রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এ সকল ক্ষেত্রে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হলেও ফলাফল পেতে বিলম্ব হচ্ছে। এ মুহুর্তে আক্রান্ত জেলা থেকে আগত প্রায় ২০ হাজার শ্রমজীবী মানুষের করোনা সনাক্ত করা জরুরী হয়ে পড়েছে। প্রায়ই বিভিন্ন উপজেলায় করোনা উপসর্গ নিয়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে যা জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারও করা হচ্ছে কিন্তু মৃত্যুর সংবাদ যথাসময়ে না পাওয়ায় দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সে সব পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ হচ্ছে। গত ১৪/১৫ দিনে আক্রান্ত জেলা থেকে আগত শ্রমজীবী মানুষের করোনা পরীক্ষা দ্রুত সময়ের মধ্যে করা সম্ভব হলে সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস পাবে এবং আক্রান্ত হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

তারা আরও বলেন, কয়েকদিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও পিসিআর মেশিন স্থাপনে স্বাস্থ্যবিভাগের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। অবিলম্বে কর্তপক্ষ’র কাছে পিসিআর মেশিন স্থাপনের দাব্যি হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডাঃ হাবিবুর রহমান বলেন, আমরা পিসিআর মেশিন স্থাপনের জন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। তারা এখনও পর্যন্ত কোনো বার্তা আমাদের পাঠাইনি। আমাদের এখানে পিসিআর মেশিন স্থাপনের জন্য যে পরিবেশ দরকার তার সবগুলোই আছে। তবে বিদ্যুৎ এর একটি সাব-স্টেশন চালু করতে না পারায় বিদ্যুৎ এর ঘাটতি পড়তে পারে। ঘাটতি পড়লে বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে তা সমাধান করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এখানে পিসিআর মেশিন স্থাপন হলে করোনা শনাক্তের জন্য আর কোনো রোগীকেও বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। এই মহা দুর্যোগ থেকে জেলার মানুষকে প্রাণে বাঁচাতে দ্রুত একটি পিসিআর মেশিন স্থাপন করা হোক আমরাও চাই।

সিভিল সার্জন ডা: হুসাইন সাফাওয়াত বলেন, করোনা উপস্বর্গে মৃত্যু ব্যক্তিদের নমুনা সংগ্রহ করা হলেও জেলায় পিসিআর মেশিন স্থাপন না হওয়ায় পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে দীর্ঘসূত্রিকা। সেজন্য স্থাপনের বিষয়ে আমিও ওপর মহলে কথা বলেছি। তবে পরিবেশগত সমস্যা, দক্ষ জনবল ও পিসিআর মেশিন সংকট দূর হলেই দ্রুত স্থাপন করতে পারে কর্তৃপক্ষ বলে জানান তিনি।
পিডিবি সাতক্ষীরার আবাসিক প্রকৌশলী জিয়াউল হক বলেন, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে করোনা রোগীর শনাক্তকরণ ল্যাব স্থাপনে কোনো ত্রুটি আছে বলে মনে হয় না। সেখানে বিদ্যুৎ এর সমস্যা নেই। আমরা সরেজমিনে যেয়ে দেখে এসেছি।

তিনি আরও বলেন, পিসিআর মেশিনে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হলেও মেডিকেলে প্রায় ৪০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ রিজার্ভ আছে। যদি কোনো কর্মকর্তা বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের দোষারপ করেন তা ভিক্তিহীন।জেলা সাংবাদিক ঐক্য পরিষদের আহবায়ক শরীফুল্লাহ কায়সার সুমন বলেন, করোনা উপস্বর্গে মৃত্যু ব্যক্তির স্যাম্পল ২ ঘন্টার মধ্যে সংগ্রহ করে পিসিআর মেশিনে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে না পারলে ফলাফল নেগিটিভ আসবে স্বাভাবিক। আমরাও ল্যাবের জন্য বারবার দাবি জানিয়েছি। পিসিআর মেশিন আমাদের সাতক্ষীরায় স্থাপন করা হলে ফলাফল পেতে বিলম্ব হতে হবে না। যদি কোনো ব্যক্তির ফলাফল পজেটিভ আসে, তাহলে তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত চিকিৎসা সেবা দিতে পারলে আরোগ্য লাভ করতে পারে তারা। আশাকরি বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অতি দ্রুত ল্যাব স্থাপনরে দাবি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জানান তিনি।

সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেশে ২১% নাগরিক দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করলেও সাতক্ষীরায় এর চিত্র ভিন্ন। এখানে ৪৬% মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। এছাড়াও জেলার বাইরে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লক্ষ মানুষ পেটে তাগিদে কাজ করেন। তাদের মধ্যেও অধিকাংশ মানুষের শিক্ষার হার অতি নগন্য। বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির জন্য তাদেরকে নিজ নিজ জেলায় ফিরতে বাধ্য করছেন। ফলে প্রতিদিন কোনো কোনো ব্যক্তি বৈধ্য ও অবৈধপথে বাড়িতে ফিরছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের বাড়িতে লাল পতাকা তুলে দিলেও তারা সামাজিক দুরুত্ব বজায় না রেখে বাইরে ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত। তাদেরকে করোনা উপস্বর্গ দেখা দিলে পরীক্ষার মাধ্যমে সচেতন করা একমাত্র পথ। কিন্তু সেই করোনা পরীক্ষাগারও নেই সাতক্ষীরায়। যার ফলে বিড়ম্বনায় রোগীর স্বজনরাও।

তিনি আরও বলেন, এপ্রিলের প্রথমে করোনা পরীক্ষাগার স্থাপনের জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা দাবি তুলেছেন। সেই দাবির প্রেক্ষিতে এমপি ও ডিসি করোনা পরীক্ষাগার স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও সাতক্ষীরায় করোনা পরীক্ষাগার স্থাপনের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য আমরা জানতে পারিনি। এমতাবস্তায় করোনা উপস্বর্গে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারও অসহায় হয়ে পড়েছে। সেজন্য জরুরী ভিক্তিতে সাতক্ষীরায় একটি পিসিআর মেশিন স্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

স্বাস্থ্য বিভাগের উদাসীনতার কারণেই সাতক্ষীরায় এখন পর্যন্ত করোনা পরীক্ষাগার স্থাপন হয়নি অভিযোগ করেন সাতক্ষীরা অনলাইন প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসাইন। তিনি বলেন, করোনা আক্রান্ত হয়ে সাতক্ষীরা শহরের উত্তর কাটিয়া এলাকায় নিজ বাড়িতে ফিরে এসেছে যশোরের শার্শা উপজেলার এক স্বাস্থ্যকর্মী। এর আগেও যশোরের শার্শা এলাকায় কোয়ারেন্টিনে থাকা শ্যামনগর উপজেলার এক ব্যক্তির করোনাভাইরাস ধরা পড়ে, তা নিয়ে জেলা জুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করলেও করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পরীক্ষাগার স্থাপনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি স্বাস্থ্যবিভাগের কোনো কর্মকর্তারা। আমরা চাইবো অনতিবিলম্বে যেন করোনা রোগীদের শনাক্তের জন্য নির্ধারিত সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের ১০০শ’ শয্যা হাসপাতালেই ল্যাব স্থাপন করা হয়।

সাবেক ফিফা রেফারী তৈয়ব হাসান বলেন, আমাদের জেলায় কোনো করোনা পরীক্ষাগার নেই। জেলা থেকে পৃথক যেসব এলাকা রয়েছে তার মধ্যে গাবুরা অন্যতম। জেলা শহর থেকে গাবুরায় যেতে প্রায় ৩ ঘন্টা সময় লেগে যায়। করোনা সন্দেহ কোনো ব্যক্তি পরীক্ষা করতে চাইলে তাকে পার্শ্ববর্তী জেলা খুলনা যেতে হবে। সাতক্ষীরা থেকে খুলনায় যেতে প্রায় ২ ঘন্টা সময় লাগে। সেখানে যেয়ে তো কোনো ব্যক্তির পক্ষে করোনা পরীক্ষা করতে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এমতাবস্থায় সাতক্ষীরায় একটি পিসিআর মেশিন স্থাপন জরুরী হয়ে পড়েছে। মেশিনটি স্থাপন করা হলে জেলার মানুষ যেমন দ্রুত পরীক্ষার ফলাফল পাবে তেমনি তাদের সময়ক্ষেপণ হবে না। তাই, জরুরী ভিক্তিতে পিসিআর মেশিন স্থাপনের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপ করেন তিনি।

নাগরিক আন্দোলন মে র সভাপতি অ্যাড. ফাইমুল হক কিসলু বলেন, জেলার অধিকাংশ মানুষ এখন করোনা উপস্বর্গে আক্রান্ত। করোনার সংক্রমণের নমুনা পরীক্ষার কোনো ল্যাব না থাকায় তাদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে। আমরা বহুবার দাবি তুলেছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এখনও বিষয়টির কোনো সুরাহ করেননি। আশাকরি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করবেন স্বাস্থ্যবিভাগের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষরা।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)