চলতি মৌসুমে ২১ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হবে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনাভাইরাসে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে চলতি মৌসুমে ২১ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া চলতি বোরো মৌসুমে আগের বছরের চেয়ে বেশি ধান, আতপ চাল ও গম সংগ্রহ করা হবে।
তিনি বলেন, সাধারণ বোরোতে আগে যা আমরা নিতাম, তার চেয়ে অনেক বেশি আমরা নিচ্ছি। এখন প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন ধান, ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল, ২ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল এবং ৮০ হাজার মেট্রিক টন গমসহ সর্বমোট ২১ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হবে।
শেখ হাসিনা আরো বলেন, এটা সরকার কিনে রাখবে। তাতে আমাদের আর ভবিষ্যতে কোনো অভাব হবে না। আমরা মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিতে পারবো।
আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর সরবরাহ সঠিক রাখতে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে উল্লেখ করে তিনি বাজারে পণ্য সরবরাহ বজায় রাখতে মনিটরিং জোরদারকরণেও প্রশাসনকে নির্দেশ দেন।
সোমবার সকালে নিজ সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা এবং ময়মনসিংহ বিভাগের আটটি জেলার জনপ্রতিনিধি ও পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময়ের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
ভিডিও কনফারেন্সে জেলা প্রশাসনসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, সিভিল সার্জনসহ চিকিৎসক, স্থানীয় মসজিদের ইমাম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি এবং স্থানীয় সাংবাদিকসহ ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং আইইডিসিআর সংযুক্ত ছিলো।
জেলাগুলো হচ্ছে- ঢাকা বিভাগের মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ সদর।
এর আগে শেখ হাসিনা করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে ৪ দফা পৃথক ভিডিও কনফারেন্সে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট এবং বরিশাল বিভাগের ৪৩টি জেলার সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস ভিডিও কনফারেন্সটি সঞ্চালনা করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, পিএমও সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং প্রেস সচিব ইহসানুল করিম গণভবন প্রান্তে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের খাদ্যের কোনো অভাব হবে না। তাছাড়া এখন ধান উঠছে। ধান কাটাও শুরু হয়ে গেছে। আগামীতেও ফসল উঠবে। সেই সঙ্গে তরিতরকারি ফলমূল যে যা পারেন উৎপাদন করবেন। ধান কাটায় সহযোগিতার জন্য তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক এবং ছাত্র সমাজের প্রতি তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
শেখ হাসিনা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দেশে কোনো জমি ফেলে না রাখার পাশাপাশি একই জমিতে একাধিক ফসল ফলানোর অংশ হিসেবে ধান কাটার পরপরই সেই জমিতে অন্য ফসল লাগানোর ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, এই সংকটে দেশে যেন খাদ্যর সমস্যা না হয় সেজন্য সব জমিতে ফসল ফলাতে হবে। দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে সেদিকে সবাই দৃষ্টি দেবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এরইমধ্যে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছি, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। কৃষিখাতে আরো বেশি। মাত্র ৪ শতাংশ সুদে আমরা কৃষি ঋণ দিচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, আমরা ধাপে ধাপে রফতানিমুখী খাত, বৃহৎ শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যবসায়ীর জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছি। পরে কৃষি খাতের জন্য প্রণোদনা দিয়েছি। এই প্রণোদনা কেবল ধান চাষিদের জন্য নয়, মৎস্য-পোল্ট্রি-ডেইরি সব খাতকে প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে, কোনো খাত প্রণোদনা থেকে বাদ পড়বে না।
করোনা যুদ্ধ মোকাবিলায় সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশই এই প্যাকেজ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে, তা শুধু এই বছরের জন্য না। আগামী তিন বছর দেশের অর্থনীতির চাকা যাতে সচল থাকে সেটা মাথায় রেখেই এই প্রণোদনা। এটা অব্যাহত রাখা হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত ৫০ লাখ সুবিধাভোগীর সঙ্গে রেশন কার্ডের মাধ্যমে আরো ৫০ লাখ যোগ করে সুবিধাভোগীর সংখ্যা এক কোটিতে উন্নীত করা হয়েছে। এছাড়া প্রায় ৫ কোটি লোককে সহযোগিতা প্রদানে সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
তিনি নতুন ৫০ লাখ লোকের তালিকায় দলমত নির্বিশেষে যাদের প্রয়োজন সেরকম কেউ যেন বাদ না পড়ে এবং যারা হাত পাততে পারেন না তেমন কেউ যেন খাদ্য সাহায্য বঞ্চিত না হন, তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেন।
ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং যেকোনো ধরনের অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথাও প্রধানমন্ত্রী সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন।
করোনাভাইরাসের বিস্তাররোধে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং অবস্থান পরিবর্তন না করে নিজ নিজ অবস্থানে থাকার আহ্বানও পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, করোনা সংকট মোকাবিলায় আমরা মানুষকে সচেতন করতে পেরেছি বলেই করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সবাই সচেতন হলে করোনা থেকে বাঁচা সম্ভব হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আরেকটু সচেতন হলেই বাংলাদেশে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন এবং অযথা ঘোরাঘুরি করে নিজেকে এবং অন্যের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলবেন না।
সারাদেশে করোনা চিকিৎসায় কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার জন্য ৫০৭ প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, করোনার কারণে সারাবিশ্ব আজ আতঙ্কিত। বিশ্বের প্রায় আড়াইশ কোটি মানুষ ঘরবন্দি। বিশ্ব আগে কখনো এমন পরিস্থিতি দেখেনি। করোনায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির। বন্ধ রয়েছে মসজিদ-মন্দির-গির্জা, প্যাগোডাসহ সব প্রার্থনার কেন্দ্র। সবাইকে ঘরে বসেই নামাজ আদায় করার এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার আহ্বানও তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি ভালো আছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি চলমান এপ্রিল মাসে যেন সংক্রমণ অধিকহারে বাড়তে না পারে সেজন্য সবাইকে সতর্ক করে বলেন, এপ্রিল মাসটি আমাদের জন্য একটু কষ্টকর হবে। এ মাসে সাবধানে থাকতে হবে। তারপরও ইউরোপ-আমেরিকায় যে পরিমাণ রোগ সংক্রমিত হয়েছে তার তুলনায় আমাদের দেশে কম। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেই বাঙালি মারা গেছে।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশিদের মৃত্যুতে তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি খুলে দেয়ার পূর্বে কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা পূর্বক সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে উল্লেখ করেন। অতীতে চিন্তা-ভাবনা না করেই হঠাৎ কারখানা খুলে দেয়ার কারণে কর্মীদের ঢাকা আসা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা নিয়েও কথা বলেন। কিছু কিছু শিল্প কারখানা খুলে দেয়া ছাড়া উপায় নেই বলেও তিনি জানান।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মেডিকেল সামগ্রী বুঝে নেয়ার ক্ষেত্রে কেবল মোড়ক না দেখে ভেতরের বস্তুটিও দেখে এবং বুঝে নেয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী দুর্যোগের সময় ভেঙে না পড়ে বরং সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্যও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দুর্যোগে ভেঙে পড়া যাবে না। শিগগির সংকট কেটে যাবে। সাহসের সঙ্গে আমাদের এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা চিন্তা করেন। সমগ্র বাঙালি জাতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেছে।
তিনি বলেন, অনেকেই সবকিছু ছেড়ে দিয়ে অস্ত্র হাতে নেমে পড়েছিলো, তাদের পোশাক ছিলো না, একেবারে খালি পায়ে। লুঙ্গি পরে অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। মনে সাহস নিয়েই আমরা বিজয় অর্জন করেছি।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, এবারও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সেই সাহস নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এখানেও বাঙালিকে জয়ী হতে হবে। সেই চিন্তা ভাবনা নিয়েই কাজ করা হচ্ছে।