করোনা, চিকনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর লক্ষণ শনাক্তকরণ
করোনাভাইরাস আতঙ্কে সারা পৃথিবীর মানুষ আজ গৃহবন্দী। প্রায় ৪ মাস আগে ভাইরাসটি চীনে সর্বপ্রথম আবিষ্কার হলেও দাবানলের মতো দ্রুত সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও এখন এই প্রাণঘাতী ভাইরাসটিতে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। রোববার পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে মোট ৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া সারাদেশে ২৪৫৬ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। করোনা আতঙ্কে যেকোনো জ্বর, শরীর ব্যথা, হাঁচি-কাশি হলেই হাসপাতাল কিংবা আইইডিসিআরের দিকে ছুটছে মানুষ। কিন্তু এসব লক্ষণ মানেই কি করোনাভাইরাস?
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসদের মতে, সর্দি-কাশি হলেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এটা মনে করার কিছু নেই। ঋতু পরিবর্তনের ফলেও আমাদের দেশে প্রতি বছরই অনেক মানুষ এসব সমস্যায় ভুগেন।
তাদের মতে, ভাইরাসটি যেহেতু দেশের কমিউনিটিতে ট্রান্সমিশন হতে শুরু করেছে, তাই আতঙ্কিত না হয়ে রোগের লক্ষণ উপসর্গগুলো আগে দেখে নিতে হবে। কোনো ব্যক্তির মাঝে করোনার সংক্রমণ হলে সবসময়ই তার শরীরে জ্বর থাকবে, কিন্তু সেটা খুব বেশি নয়। সাধারণ ঠান্ডা, জ্বর কিংবা অ্যালার্জিজনিত সমস্যায় মাথাব্যথা হলে করোনাভাইরাসেও মাথাব্যথা হতে পারে।
সাধারণ রোগে শরীর ব্যথা ও দুর্বলতা না থাকলেও করোনায় এমনটা হতে পারে। তবে সর্দি, কাশি কিংবা বার বার হাঁচিতে গলা ব্যথা অন্য জ্বরের লক্ষণ হলেও করোনাভাইরাসের বেলায় তা বারবারও বেশি বেশি অনুভূত হবে। অন্য জ্বরে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা তেমন না হলেও করোনা মারাত্মক হলে এ সমস্যা প্রকট হয়।
তাই এই সময়ে জনগণের আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন থাকা জরুরি। বিশেষ করে প্রবাসীদের ক্ষেত্রে একটু বেশি সচেতন থাকতে হবে। কারণ তারাই এ দেশে এই রোগের বাহক।
বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে জ্বর, কাশি বা শরীর ব্যথা হলেই মানুষ আতঙ্কিত হয়ে বেশি বেশি চিকিৎসক বা হাসপাতালমুখী হচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সেব্রিনা ফ্লোরা ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, এখন জ্বর হলেই অনেক সময় দেখা যাচ্ছে আমরা তাকে করোনা ভাবছি। কিন্তু একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, বর্তমান সময় দেশে এডিস মশার জন্য উর্বর। তাই আমরা যারা বাড়িতে আছি, তারা যেন বাড়ির পরিচ্ছন্নতার দিকে লক্ষ্য রাখি। যাতে বাড়ি আঙ্গিণায় কোথাও যেন পানি জমে না থাকে। কারণ বৃষ্টি শুরু হলেই কিন্তু ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হবে। সেক্ষেত্রে ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য এখন থেকেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ প্রয়োজন। যেন কোথাও পানি জমে না থাকতে পারে বা কোন জায়গায় যাতে এডিস মশা ডিম পাড়তে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
তিনি আরো বলেন, এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বড় লক্ষণ সর্দি-কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, শরীর ব্যথা, ডায়রিয়া। তবে আমাদের দেশের আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে জ্বর, ঠান্ডা, কাশি হতেই পারে। কিন্তু বর্তমানে যেহেতু করোনাভাইরাস নিয়ে পুরো বিশ্ব উদ্বিগ্ন, তাই বাড়তি সতর্কতায় থাকা আবশ্যই প্রয়োজন। তবে জ্বর হলেই প্রথমে করোনা ভেবে আতঙ্কিত হবেন না, আমাদের হট লাইনে যোগাযোগ করে নমুনা পরীক্ষার পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন ও সচেতনতা বৃদ্ধি করুন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. আক্তার হোসেন ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, যেকোনো ভাইরাসজনিত রোগেই শরীরে মাংসপেশী ব্যথা হতে পারে। করোনা, ডেঙ্গু কিংবা চিকুনগুনিয়া তিনটি রোগই ভাইরাসজনিত।
করোনা বা কভিড-১৯ হলে সর্দি, কাশি, জ্বর, শরীর ব্যথা, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট সবগুলো উপসর্গই আক্রান্ত রোগীর মধ্যে থাকবে। তবে শ্বাসকষ্ট ছাড়া বাকিগুলা খুব বেশি তীব্র নয়। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে শ্বাসকষ্টের জন্যই মূলত হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। আর ডেঙ্গু হলে, শরীরের তাপমাত্রা ১০৩-১০৫ ডিগ্রি হতে পারে এবং হাড়ে ব্যথা থাকবে।
এছাড়াও ডেঙ্গু হলে চোখের নিচে, চামড়ার নিচে রক্তের জমাট বেঁধে দাগ হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় চোখের সাদা অংশে রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। আল্ট্রাসনোগ্রাম করলে পেটে পানি ও মুখে পানি দেখা দিতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরের সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো (ডেঙ্গু শক সিমটম)। যেটা থেকে রক্তের মাধ্যমে পানি বের হয়ে আসে।
এদিকে চিকুনগুনিয়া হলে রোগীর শরীরে জ্বর এবং জয়েন পেইন হবে। এখানে জ্বর ১০০-১০৪ পর্যন্ত হতে পারে। এটার আলাদা আইডেন্টিফিকেশন হলো জয়েন পেইন। মারাত্মক ব্যথা করে। এমনকি রোগী হেঁটেও ডাক্তারের কাছে আসতে পারে না। অনেক সময় রোগী তার শরীরের ভর বহন করতে পারে না।
করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. আক্তার হোসেন বলেন, করোনা একটা নতুন ভাইরাস। মাত্র চার মাস হয়েছে এর বয়স। এটি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এখন পর্যন্ত করোনার স্ট্রাকচার এন্টিবডি কী হবে এটাই আমরা তৈরি করতে পারিনি। শুধু আমরা নয়, পৃথিবীর কেউ এখন পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি। এমনকি দ্বিতীয়বার এই রোগ হয় কিনা এ বিষয়টাও আমরা এখনো নিশ্চিত না।
করোনার প্রতিষেধক কবে দেশে আসতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনার স্পেসিফিক এখনো কোনো ট্রিটমেন্ট বের হয়নি। জ্বর হলে প্যারাসিটামল, ডায়রিয়া হলে স্যালাইন, ঠান্ডা লাগলে ঠান্ডার ওষুধ খেতে হবে। উন্নত দেশগুলো এরইমধ্যে করোনার প্রতিষেধক নিয়ে কাজ শুরু করেছে। অনেক দেশই দাবি করছে, তারা কিছুদিনের মধ্যেই প্রতিষেধক আবিষ্কার করবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতিরোধের একটাই উপায় সেটা হলো, ঘরে থাকা এবং সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা।