সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে শিগগিরই মুক্তির আশাবাদ ব্যক্ত করে সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, যে আঁধার আমাদের চারপাশকে ঘিরে ধরেছে, তা একদিন কেটে যাবেই। বৈশাখের রুদ্র রূপ আমাদের সাহসী হতে উদ্বুদ্ধ করে। মাতিয়ে তোলে ধ্বংসের মধ্য থেকে নতুন সৃষ্টির নেশায়।
সোমবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।-বাসস
বাংলা নববর্ষ ১৪২৭ উপলক্ষ্যে তিনি এই ভাষণ দেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভি ওয়ার্ল্ড, বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্র, বাংলাদেশ বেতারসহ সব বেসরকারি টিভি চ্যানেল এবং রেডিও স্টেশন থেকে এই ভাষণ একযোগে সম্প্রচার করা হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নজরুলের ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতার কয়েকটি পংক্তি উচ্চারণ করেন- ‘ওই নতুনের কেতন ওরে কাল-বোশেখীর ঝড়/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? / প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন/ আসছে নবীন- জীবন-হারা অ-সুন্দরে করতে ছেদন’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের যে গভীর আঁধার আমাদের বিশ্বকে গ্রাস করেছে, সে আঁধার ভেদ করে বেরিয়ে আসতে হবে নতুন দিনের সূর্যালোকে। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায় তাই বলতে চাই- ‘মেঘ দেখ কেউ করিসনে ভয়/আড়ালে তার সূর্য হাসে,/হারা শশীর হারা হাসি/ অন্ধকারেই ফিরে আসে।’
শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেন, স্বল্প-আয়ের মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করার জন্য ৫ লাখ মেট্রিক টন চাল এবং ১ লাখ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ করা হয়েছে। যার মোট মূল্য ২ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, শহরাঞ্চলে বসবাসরত নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ওএমএস-এর আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রয় কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। আগামী তিন মাসে ৭৪ হাজার মেট্রিক টন চাল এই কার্যক্রমের আওতায় বিতরণ করা হবে। এজন্য ২৫১ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করা হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র বাহিনী ও বিজিবি সদস্য এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মচারীর জন্য ৭৫০ কোটি টাকার বীমার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, যেসব সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যক্ষভাবে করোনাভাইরাস রোগীদের নিয়ে কাজ করছেন এরইমধ্যে তাদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছি। তাদের বিশেষ সম্মানী দেয়া হবে। এ জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দায়িত্ব পালনকালে যদি কেউ আক্রান্ত হন, তাহলে পদমর্যাদা অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য থাকছে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবীমা এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৫ গুণ বৃদ্ধি পাবে। স্বাস্থ্যবীমা ও জীবনবীমা বাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৭৫০ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, সুরক্ষা সরঞ্জামের কোনো ঘাটতি নেই। নিজেকে সুরক্ষিত রেখে স্বাস্থ্যকর্মীরা সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাবেন- এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। একইসঙ্গে সাধারণ রোগীরা যাতে কোনোভাবেই চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত না হন, সেদিকে নজর রাখার জন্য তিনি প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং মৃত্যু ঝুঁকি উপেক্ষা করে একেবারে সামনের কাতারে থেকে করোনাভাইরাস-আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
চিকিৎসক ও নার্সদের পেশাটাই এরকম চ্যালেঞ্জের আখ্যায়িত করে সবাইকে মনোবল ধরে রাখার পাশাপাশি সরকার সবসময় জনগণের পাশে রয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করেন।
শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা ভয় পাবেন না। ভয় মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দূর্বল করে।
তিনি বলেন, কেউ আতঙ্ক ছড়াবেন না। আমাদের সবাইকে সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। সরকার সব সময় আপনার পাশে আছে।
‘বাঙালি বীরের জাতি’ এবং ‘অতীতে নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাক বাঙালি জাতি সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে,’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। বিজয়ী জাতি আমরা। আমরা সস্মিলিতভাবে করোনাভাইরাসজনিত মহামারীকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবো, ইনশাআল্লাহ।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, নতুন বছরে মহান আল্লাহর কাছে কায়মনবাক্যে প্রার্থনা, মহামারীর এই প্রলয় দ্রুত থেমে যাক। আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
কিছু স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ সংকটকালে এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না।
তিনি বলেন, মিডিয়া কর্মীদের প্রতি অনুরোধ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সঠিক তথ্য তুলে ধরে এই মহামারী মোকাবিলা করতে আমাদের সহায়তা করুন।
করোনার সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় তার সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এরইমধ্যে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি। যা জিডিপি’র ৩.৩ শতাংশ।
করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতির উপর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব উত্তরণে তার সরকার চারটি মূল কার্যক্রম নির্ধারণ করেছে উল্লেখ করে বলেন-
(১) সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা: সরকরি ব্যয়ের ক্ষেত্রে ‘কর্মসৃজনকেই’ প্রাধান্য দেয়া হবে।
(২) আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ প্রণয়ন: অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা, শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজে বহাল রাখা এবং উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখাই হলো আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের মূল উদ্দেশ্য।
(৩) সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি: দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী জনগণ, দিনমজুর এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা হবে।
(৪) মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা: অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব উত্তরণে মুদ্রা সরবরাহ এমনভাবে বৃদ্ধি করা যেন মুদ্রাস্ফীতি না ঘটে।
নববর্ষ উদযাপন সম্পর্কে এদিন পুনরায় বাইরের সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, বাঙালির সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। প্রতিটি বাঙালি আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে উদযাপন করে থাকেন এই উৎসব। এ বছর বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে পয়লা বৈশাখের বহিরাঙ্গণের সব অনুষ্ঠানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, এটা করা হয়েছে বৃহত্তর জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে। কারণ, এরইমধ্যে এই ভাইরাস আমাদের দেশেও ভয়াল থাবা বসাতে শুরু করেছে।
এরআগে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধন অনুষ্ঠান এবং স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানও জনসমাগম এড়িয়ে রেডিও, টেলিভিশন এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সম্প্রচার করা হয়েছে। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানও আমরা একইভাবে উদযাপন করবো- বলেন প্রধানমন্ত্রী।