বাংলা নববর্ষ; রমনা থেকে ডিজিটালেই উৎসব

নিজস্ব প্রতিনিধি:

বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব। বর্ষবরণ উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশ জুড়ে বাঙালি সমাজে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন এই দিনের সাধারণ মানুষকে বিনোদন দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। তবে সব কিছুর পেছনের একটা ইতিহাস থেকে যায়। বাংলা বর্ষ বা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হঠাৎ করেই শুরু হয়নি এর পেছনেও ইতিহাস রয়ে গেছে। সব ইতিহাসকে পিছনে ফেলে এবারই বর্ষ বরণ নতুন আঙ্গিতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে বর্ষ বরণ হচ্ছে শুধুমাত্র মিডিয়া ও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ঘরে বসেই। ফলে ডিজিটাল পদ্ধতিতেই করছে হচ্ছে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময়।

মুঘল সম্রাট আকবর দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন ৯৬৩ হিজরি সনের ২৮ রবিউসসানি তারিখে। ৯৬৩ কে বাংলা বর্ষের প্রথম বছর ধার্য করে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে বর্তমান বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এর কার্যকারিতা দেয়া হয় ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে। হিজরি ৯৬৩ সন থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হলেও বর্তমানে দুটো সনের মধ্যে তারতম্য কেন এ বিষয়ে অনেকের কৌতূহল রয়েছে। খ্রিস্টাব্দ বা বঙ্গাব্দ হচ্ছে সৌরবর্ষ, পক্ষান্তরে হিজরি সন হচ্ছে চন্দ্রবর্ষ। সৌরবর্ষের চেয়ে ১১ দিন কম চন্দ্রবর্ষ। হিজরি ৯৬৩ থেকে বঙ্গাব্দ শুরু হয়ে এ পর্যন্ত পেরিয়েছে (১৪৪০-৯৬৩)= ৪৭৭ বছর। প্রতিবছর ১১ দিন হিসেবে ৪৭৪ বছরে দিনের পার্থক্য হয় ৫২১৪ দিন। এখন ৫২১৪কে ৩৬৫ দ্বারা ভাগ দিলেই পাওয়া যাবে ১৪ বছর ৮ মাস, যা বর্তমানে হিজরি ও বাংলা সনের পার্থক্য। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ নামে পরিচিত হয়। বঙ্গাব্দের বারটি মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্র মূলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে।

একেকটি অব্দের হিসাব শুরু হয় একেক সময় থেকে। খ্রিস্টাব্দের শুরু মধ্যরাত থেকে, হিজরি বর্ষপঞ্জির শুরু সূর্যাস্ত থেকে, আর বঙ্গাব্দ শুরু হয় সূর্যোদয় থেকে। বঙ্গাব্দেও লিপইয়ার বা অধিবর্ষ রয়েছে। বাংলা একাডেমি কর্তৃক ১৯৬৬ সালে গৃহীত সংশোধনী মোতাবেক বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত পাঁচ মাস ৩১ দিনের, বাকি সাত মাস ৩০ দিনের। অধিবর্ষের বছর ফালগুন মাস হবে ৩১ দিনের।

প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি। ঢাকার রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ ও মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমেই বর্ষবরণ উদযাপন শুরু হয়। ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে “এসো হে বৈশাখ” গান গেয়ে নতুন বর্ষকে বরণ করেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট এই রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। বটমূল বলে পরিচিত হলেও আসলে এটা একটা অশ্বথ বৃক্ষ। কিন্ত অনেককাল ধরে এটা মানুষের কাছে বট বৃক্ষ বলে পরিচিত। ঢাকার বৈশাখী বা নববর্ষ উৎসবের আবশ্যিক একটি অংশ হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৮৯ সাল থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের অন্যতম একটি আকর্ষণ। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন রাস্তা পদক্ষিণ করে সেখানেই শেষ হয়। কিন্তু এবার হচ্ছে না মঙ্গল শোভাযাত্রা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পহেলা বৈশাখের সকল অনুষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেন।

বৈশাখের সবচেয়ে বড় পরিচয় এর অসাম্প্রদায়িকতা। খ্রিস্টাব্দ কিংবা হিজরি, সন ইত্যাদি কোনো না কোনোভাবে বিশেষ কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কোনো বিশেষ ঘটনার স্মারক হিসেবে সৃষ্ট। কিন্তু বাংলা নববর্ষ শুধুই প্রকৃতি ও তার সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষের জীবনাচরণকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট। সে হিসেবে এমন লোকায়ত এবং আমজনতাসম্পৃক্ত সাল পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। তাই নববর্ষ বাঙালিকে আপন আলয়ের পথ নির্দেশ করে তার শেকড়ের সন্ধান দেয়। বাঙালির ভাব ও দ্রোহ নববর্ষে যুগপৎ দ্যোতনা লাভ করে, হারিয়ে যায় পুরাতন। কালবৈশাখীর মত্ত ঝাপটা শেষে পলকা ঝড়ে সিক্ত আর্দ্র মাটিতে বোনা হয় সম্ভাবনাময় ফসলের বীজ। বলা যায় যেন উপ্ত হয় কৃষকের আগামীর স্বপ্ন। সকল প্রকার ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে এই একটি দিন বাঙালির সার্বজনীন উৎসবে যার দ্বিতীয় কোনো উপমা আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। তবে আমাদের সংস্কৃতির উৎসবটি বাঙালি ডিজিটাল ভাবে পালন করবে।

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও করোনার বিষক্ত ছোবল পড়েছে জনজীবনে। বর্তমানে মানুষ বেঁচে থাকার নিরন্তন সংগ্রামে অবর্তীর্ণ হচ্ছে। উৎসব প্রিয় বাঙালি উৎসবের কথা ভুলেই গেছে। করোয়ায় আক্রান্ত হয়ে কোন মানুষ মারা গেলে তার নিকট আত্মীয় স্বজন পর্যন্ত পাশে যাচ্ছে না। এমনই বাস্তবতায় জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আরো একটি বছর। হারিয়ে যাচ্ছে অনেক স্মৃতি, গ্লানি। করোনার বিষাক্ত ছোবল যেন দ্রুত হারিয়ে যায়। বিশ্বকে নতুন বছরে এই হোক প্রত্যাশা। শুভ নববর্ষ।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)