কর্মহীন নয়; শ্রমিক-কর্মীকে সহাযোগিতা করুন

কোন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন-উৎপাদনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কর্মী-শ্রমিকরা। তাদের পরিশ্রম, দক্ষতা, মেধা, মনন ছাড়া যেমন উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা কল্পনা করা যায়না, তারাই উন্নয়নের চাবিকাঠি। নিয়োজিত দক্ষ ও অদক্ষ জনবল ছাড়া প্রতিষ্ঠান নিজে চলতে পারে না। প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের প্রয়োজন, চাহিদা, কাজের উপযোগী কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকে।

সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর শ্রমের বাজারে কাজপ্রত্যাশী ২০-২২ লাখ তরুণ আসে, যাদের মাত্র দুই লাখের মতো কর্মসংস্থান রাষ্ট্র করতে পারে। ৬-৭ লাখ লোক পাড়ি জমায় বিদেশে, বাকিরা দেশে কোনোমতে কাজ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে। দেশের ৬ কোটি ৩৪ লাখ শ্রমজীবীর মধ্যে প্রায় ৩ কোটি মানুষ কাজ করে কৃষি খাতে। বহু ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের মাধ্যমে তারা টিকে থাকার চেষ্টা করে। এর বাইরে গার্মেন্টস, নির্মাণ খাতে, পরিবহন খাতে, দোকানে, শপিং মলে, পাট, চা, চামড়া, তাঁত, রি-রোলিং, মোটর মেকানিক, লবণ, চিংড়ি, সংবাদমাধ্যম, হাসপাতাল-ক্লিনিক, পুস্তক বাঁধাই, হকার, রিকশা-ভ্যান চালক, ইজিবাইক চালক, সিকিউরিটি গার্ডসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। শ্রমশক্তির এক কোটি দুই লাখ লোক প্রাতিষ্ঠানিক খাতে আর বাকিরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকে। মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে ৪৩টি সেক্টরের শ্রমজীবীদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা থাকলেও বাকি কোটি কোটি শ্রমিকই ‘কাজ নাই তো মজুরি নাই’ নীতিতে কাজ করতে বাধ্য হয়ে থাকে।

বর্তমানে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দেশের অর্থনীতি থমকে যাওয়ার মতো অবস্থায় আছে। করোনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কোথায় গিয়ে থামবে তা কেউ বলতে পারবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা মোকাবেলা ও অর্থনীতি সচল রাখতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। নতুন করে শঙ্কা সৃস্টি করেছে বিশ্ব অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব। রপ্তানি পোশাক খাতের অর্ডার বন্ধ হচ্ছে। সামগ্রিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ব্যবসা। অন্যদিকে, নতুন করে সৃস্টি হয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মী-শ্রমিক ছাঁটাই আতঙ্ক। ইতোমধ্যে সিম্পোনি মোবাইল কোম্পানী ৬০-৬৫ জন কর্মী ছাটাই করার নোটিশ দিয়েছেন। প্রত্যেক সেক্টরে কমবেশি কর্মী-শ্রমিক ছাটাইয়ে একই অবস্থা বিরাজ করছে ব্যবসা মন্দের দোহায় দিয়ে। গত ১৯-৩১ মার্চ পর্যন্ত ১ হাজার ৯০৪টি বন্ধ তৈরি পোশাক কারখানায় ২১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৭৮ জন শ্রমিক এবং অন্যান্য ১৪ হাজার ৮৬৪টি বন্ধ কারখানা শিল্প কারখানায় ১০ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫৩ জন শ্রমিকসহ মোট ৩২ লাখ ৮ হাজার ৬৩১ জন শ্রমিক কর্মহীন রয়েছেন বলে শ্রমিক সংশ্লিস্টরা দাবী করছেন। ফলে কর্মী-শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে। চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে খেটে খাওয়া শ্রমিক-কর্মীরা।

প্রতিষ্ঠান প্রাণ হারায় তখন, যখন স্বপদে থাকা ব্যক্তিরা অধ:স্তনদের সকলকে কাজে না লাগিয়ে নিজেদের পদে আসীন থাকার চেষ্টায় নানাভাবে জড়িয়ে পড়ে। এতে পক্ষপাত তৈরি হয় নানা বিষয়ে। কর্মী ছাঁটাই তারই অংশ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কর্মী-শ্রমিক ছাঁটাই মটেও যুক্তিযুক্ত নয়; অন্তত মানবিক দৃষ্টিতে। হ্যাঁ, ব্যবসা বন্ধ আছে, লোকসান যাচ্ছে, ঘরভাড়া দিতে পারছেন না, ব্যাংকের কিস্তি দিতে পারছেন না এইতো সমস্যা। তারপরও বলবো ব্যবসা তো সারা জীবন করেছেন। কর্মী-শ্রমিকরা আপনাদের দিকে চেয়ে আছে। আপনারাই তাদের রক্ষা কর্তা, অন্নের যোগানদাতা। কাজের বিনিময়ে আপনারাই তাদের মুখে অন্ন যোগাচ্ছেন। এই বিপদে আপনার প্রতিষ্ঠানই তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। তাদের ছুড়ে ফেলবেন না। দেখবেন সৃস্টিকর্তার পরম করুনায় তাদের দ্বারা আপনি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছেন।

ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে দেশের কোটি মানুষ। অনেক সময় প্রয়োজনের তুলনায় অল্প বেতন বা পারিশ্রমিকে তারা অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছে হোটেল, পরিবহন, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পরিবহন, শপিং মল, ছোট বড় এনজিওসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানের মালিকরা সমাজের প্রতিষ্ঠিত ও ধনবান হিসেবে পরিচিত। আপনার প্রতিষ্ঠানকে যে কর্মীরা পরিশ্রম করে এতোদিন বাঁচিয়ে রেখেছিলো আপনার একটি ‘না’-তে তারাই অন্ধকারে যাচ্ছে। একটি কাজের পথ বন্ধ হলে নতুন পথ খোঁজার সময় এখন না। এখন প্রয়োজন নেই, লোকসানের ব্যবসা ছোট করতে হচ্ছে দোহায় দিয়ে তাদের ছাঁটাই করবেন না। তাদের যাওয়ার যায়গা থাকবে না। সহযোগিতা মনে করে হলেও তাদের পাশে দাঁড়ান, দুঃসময় কেটে আলো আসবেই।

পবিত্র রমজান মাস ও ঈদুল ফিতর আসন্ন। এই অবস্থায় শ্রমিক ছাঁটাই করলে একদিকে যেমন তাদের জীবনধারণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে তেমনি স্বাভাবিক সময়ে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে পড়বে, যা পরবর্তিতে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যেতে পারে। পরিবার পরিজন নিয়ে মানুষের ভাবনা একটাই সুস্থ্য থাকা ও দুবেলা দুমুঠো খাওয়া। পেট তো কারো কথা শোনে না। রমজান মাসে আমাদের মুসলিম বিত্তশালীরা যাকাত প্রদান করেন। সেই যাকাতের শাড়ি না দিয়ে এবার আপনার প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের প্রদান করুন। বাড়ির আশে পাশের ৪০ ঘর অসহায় মানুষকে চাল-ডাল প্রদান করুন। মানুষের দুর্দিন কিছু হলেও কমবে।

ফরাসি বিপ্লবের আকাঙক্ষা এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার চেতনার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল মে দিবসের চেতনা। ফরাসি বিপ্লব শুধু সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার স্লোগান তোলেনি, সঙ্গে সঙ্গে মত প্রকাশের, মত প্রচারের, মত প্রতিষ্ঠার অধিকারেরও জন্ম দিয়েছিল। মানুষ বাঁচবে কীভাবে, মর্যাদা আর অধিকার ছাড়া মানুষের জীবন কি পশুর জীবনের মতোই হয়ে যায় না? গ্রাম থেকে উঠে আসা কারখানা শ্রমিককের জীবন বাঁচাতে আপনিই একমাত্র অবলম্বন। প্রয়োজেন কর্মী-শ্রমিকদের সাথে জাতির এই ক্রান্তি লগ্নে বসুন। যে প্রতিষ্ঠানের নূন খেয়েছে তারা তার সাথে থাকবে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ঠিক না হওয়া পর্যন্ত নূন্যতম জীবন ধারণের জন্য বেতন-সম্মানী নিতেও তারা দ্বিধা করবে না। তাদের কম বেতন দিন, কিন্তু কর্মহীন করবেন না।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)