গুজবে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে দিশাহারা হতদরিদ্র মানুষ:করোনা ভাইরাস
করোনা ভাইরাসকে পুঁজি করে আমাদের দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির পায়তারা করেছে একটি অসাধু মহল। করোনায় মূল্যবৃদ্ধির হাওয়া বইছে দেশজুড়ে। ইতোমধ্যে বেশকিছু নিত্যপণ্যের আমদানি মূল্যের তুলনায় বিক্রয় মূল্য অযৌক্তিক হারেই বৃদ্ধি পেয়েছে।
করোনাভাইরাস আসছে এই সুযোগে যেসব ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। এরপরেও পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হচ্ছে বা করছে যা কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ও আইনগত প্রতিকারের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। সবার মনে সৃষ্টি হয়েছে অজানা ভয়-শঙ্কা। বাংলাদেশে অধিক মুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ভোক্তাদের জিম্মি করার ঘটনা নতুন কিছু নয়। পেয়াজ এবং লবণ নিয়েও এধরনের ঘটনা দেখেছি। কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার সাহস হারিয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র পরিবারগুলো কিভাবে জীবন নির্বাহ করবে? কিছুদিন আগে এক কেজি আলুর দাম ছিল ১০-১৫ টাকা। করোনার প্রকোপে তা বেড়ে হয়েছে ১৫-২০ টাকা। কোথাও আবার আরো বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় এসব পণ্য। এখন দোকানদারও হয়ে গেছে এক জবানের বিক্রেতা। দর-কষাকষির কোনো সুযোগ নেই। সুযোগ থাকবেই–বা কীভাবে? আপনার পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো আরেক ক্রেতা যে ওই দামেই নিচ্ছেন! করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মুখে বিভিন্ন মাত্রায় হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্ববাজার। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মাত্রায় আক্রান্ত হয়েছে খাদ্য, পোশাক থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার। আমরা জানি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ বহু পণ্যের কাঁচামাল উৎপাদক চীন। দেশটি বর্তমানে করোনা ভাইরাসের কবলে পড়ায় আক্রান্ত হয়েছে এর বাণিজ্য অবকাঠামো। এরই ফলশ্রুতিতে আক্রান্ত হয়েছে বিশ্ববাজার।
এ পরিস্থিতিতে চীন ছাড়াও অন্তত ২৪টি দেশ শত শত কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে কয়েক ডজন শিল্পখাত। তবে বাস্তবতার তুলনায় গুজবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্ববাজার। এতে স্থানীয়দের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী এ পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে বাড়তি মুনাফার সুযোগ খোঁজে, আবার অনেক মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। করোনা ভাইরাসের দোহাই দিয়ে যে কোনো দেশেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। করোনা ভাইরাস সংকটের মুখে চীনের আমদানি-রফতানিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এতে চীনের খাদ্যের বাজারও হুমকিতে পড়েছে। সঙ্কট দেখা দিয়েছে মাংসের বাজারে। এ অবস্থায় কঠিন সময়ের দিকে এগিয়ে চলেছে ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশের নামীদামী ব্র্যান্ড ও পোশাক খাত। এভাবে একের পর এক সংকট বাংলাদেশকে পিছিয়ে রাখছে। করোনা ভাইরাস আতংকে সরকারিভাবে বাজার মনিটরিং করা হলেও হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে সকল দ্রব্যমূল্যের দাম। অস্থির হয়ে উঠেছে সাতক্ষীরাসহ সারাদেশের দ্রব্যমূল্যের বাজার দর। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, বেনাপোল, নীলফামারীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশাসন কিছু ব্যবসায়ীদের জরিমানা করলেও অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে জনসমাগম এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে। ৩১ মার্চ পর্যন্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শপিংমল কিংবা দোকানপাট কখন যে বন্ধ হয়ে যায়, সে আশঙ্কায় নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্য বেশি পরিমাণে কিনে বাসায় মজুত করতে শুরু করেছে জনগণ। এ সুযোগে একটি স্বার্থান্বেষী মহল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের সংকটের গুজব ছড়িয়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় বাজার অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করছেন সমাজের সচেতন মহল। বাজার পরিস্থিতি পাল্টানোর জন্য সবার আগে প্রয়োজন বিক্রেতাদের অসৎ, লোভী ও প্রতারণামূলক মানসিকতার পরিবর্তন। এই পরিবর্তন কবে ঘটবে তার জন্য অপেক্ষায় ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। এর জন্য রাষ্ট্র-সমাজের সচেতন মহলকে ভূমিকা রাখতে হবে। করোনা ভাইরাসকে পুঁজি করে বাজারে চাল, ডাল, আলু, পেয়াজসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে। অনেকের অযৌক্তিক বাড়তি কেনাকাটায় সুযোগও নিচ্ছেন। হঠাৎ এভাবে দাম বাড়িয়ে দেয়া কিংবা ভোক্তাদের বাড়তি কেনার প্রবণতা কোনোটিই যৌক্তিক নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন বাজারে খুচরায় কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বাড়তি দামে চাল বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি পণ্যের দাম যদি এভাবে বাড়ানো হয় তাহলে আমরা সাধারণ জনগণ কিভাবে জীবনযাপন করবো।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিক। এদিকে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে হতদরিদ্র মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়েছে। কাজেই নিত্যপণ্যের বাজারের অস্থিরতা দূর করার জন্য সময়মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সিন্ডিকেটের আস্ফালন দূর করতে হবে। তবে এটা নতুন কিছু নয়, নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্য তো বটেই, সেবা খাতেও সিন্ডিকেটের হস্তক্ষেপ প্রকট। একজন নাগরিকের বেঁচে থাকার জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। পরিবার ও রাষ্ট্র এসব সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। তবে অন্যান্য অধিকার থেকে ভোক্তা অধিকার একটু আলাদা। উৎপাদিত পণ্য ও সেবা চূড়ান্ত ভোগের জন্য যিনি ক্রয় করেন, অর্থনীতির ভাষায় তাকে ভোক্তা বলে। একজন ব্যক্তি যখন কোনো পণ্য ক্রয় করেন, তখন তার জানার অধিকার রয়েছে পণ্যটি কবে, কোথায় এবং কী কী কাঁচামাল ব্যবহার করে উৎপাদিত হয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে একজন বিক্রেতা বাধ্য। যদি বিক্রেতা এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন, তখন আইন অনুযায়ী সেটা ভোক্তা অধিকার ক্ষুন্ন হয়। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকার ৮টি। এগুলো হল- মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার, জানার অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, সুস্থ পরিবেশের অধিকার। পণ্য ক্রয়ে প্রতারণার হাত থেকে ভোক্তাদের সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে বহুল প্রতীক্ষিত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইনের ফলে কোনো ভোক্তা পণ্য ক্রয়ে পণ্যের ওজন, পরিমাণ, উপাদান, মূল্যসহ কোনো বিষয়ে প্রতারিত হলে তার প্রতিকার পেয়ে থাকেন। ভোক্তা অধিকার আইন সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে। সবাই সচেতন হলেই আইনটির সঠিক বাস্তবায়ন হবে। সচেতনতার মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য ও ভেজালমুক্ত পণ্যের বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। করোনাভাইরাস যেভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে তাতে সকলেই আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। এর মধ্যে যদি সামান্য মাস্ক, টিস্যু, হ্যান্ডওয়াস ও ন্যাপকিনের দামও বেড়ে যায় তাহলে সেটা মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হবে। তাই ভেজাল পণ্য ও দাম বৃদ্ধি কার্যক্রমের সাথে সুযোগ সন্ধানী জড়িত ব্যক্তিদের আটক এবং মোবাইল কোর্ট অথবা উপযুক্ত আদালতে বিচারকার্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। নিরাপদ খাদ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে অর্থনৈতিক এ বৈষম্য সামাজিক জীবনে অশান্তি ও উচ্ছৃঙ্খলা বাড়িয়ে তুলছে। এসব দুঃসহ অবস্থার প্রতিকারের এখনই সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনকে সক্রিয় হতে হবে। পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া ভূতপূর্ব মহামারির ইতিহাস নতুন কিছু নয়। করোনাভাইরাসের নিয়ন্ত্রণও একদিন মানুষের হাতের মুঠোয় আসবে।
এজন্য সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা। সংকটকালে অহেতুক আতঙ্কিত হয়ে বেশি করে কেনাকাটা করবেন না। মনে রাখুন, দেশে হঠাৎ জনসংখ্যা বাড়ছে না। তাই নিত্যপণ্যের যে মজুদ ছিল, যে চাহিদা ছিল; তা-ই আছে। আগে যেভাবে কেনাকাটা করতেন, সেভাবেই কেনাকাটা করুন। দুধ, ওষুধ ও খাদ্যের মতো প্রয়োজনীয় দ্রব্যের কোনও অভাব নেই। কিন্তু আপনি যদি বেশি করে কিনতে শুরু করেন, অন্যরাও কিনতে শুরু করবে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হবে। এতে আর্থিক ক্ষতি আপনারই হবে। মাঝখান দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার চর্চা করুন। জমায়েত এড়িয়ে চলুন। শৃঙ্খলা শিখুন। সংযমী হোন। সংযম ও সংকল্পকে কাজে লাগিয়ে সবাই মিলে করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হোন। বেঁচে থাকা মানেই এক লড়াই। আপনি প্রতি মূহুর্তে প্রতি নি:শ্বাসেও সেই লড়াই করছেন এবং জিতে যাচ্ছেন। করোনা-লড়াইয়েও জিততে হবে। জিতবেনও আপনি। সারাদেশে দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে এটিই আমাদের প্রত্যাশা।