বিমান তলিয়ে গেলেও মহাসাগরে বেঁচে রইলেন দুই পাইলট
প্রশান্ত মহাসাগরে তলিয়ে গেল বিমান। তবে বেঁচে রইলেন দুই পাইলট। জেলিফিশের কামড়ে জ্ঞান হারিয়েও মারা যাননি তারা একজন। ভাবছেন কীভাবে সম্ভব? এমনই এক রোমাঞ্চকর ঘটনার সম্মুখীণ হয়েই প্রাণে বেঁচেছেন দুই সাহসী পাইলট। তাদেরই বেঁচে ফেরার গল্প থাকছে সাতরং এর পাঠকের জন্য-
দুই ইঞ্জিনের পাইপার অ্যাপাচি বিমানটি উড়ছে নীল আকাশে। তখন সেটি প্রশান্ত মহাসাগরের পাঁচ হাজার ফুট উপরে। বিমান চালাচ্ছিলেন ২৩ বছর বয়সী নারী বৈমানিক সিডনি উয়েমোতো এবং তার সঙ্গে সহকারী পাইলট হিসেবে ছিলেন ২৬ বছর বয়সী ডেভ ম্যাকমাহন। সেদিনই প্রথম তারা একসঙ্গে বিমানটি চালাচ্ছিলেন। এর আগে দেখা হলেও কারোর সঙ্গে কারোর কথা বলার সুযোগ হয়নি। বিমান চূড়ান্তভাবে উড়ানোর পূর্বে তারা একটি শর্ট ট্রিপ দিচ্ছিলেন। আর তাই বিমানে কোনো যাত্রী ছিল না। এমনকি তারা দু’জন ছাড়া আর কোনো ক্রুও ছিল না বিমানটিতে। এই ঘটনাটি ঘটে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে।
তাদের যাত্রা পথ ছিল ওয়াহু থেকে কনা, হাওয়াই দ্বীপে। শুরুতে কোনো সমস্যা না থাকলেও উড়ার কিছুক্ষণ পরই একটা বিকট শব্দ শুনতে পেলেন তারা দু’জনেই। এরপরই বিমানের ইঞ্জিনের যে স্বাভাবিক শব্দ, সেটা পাল্টে গেল। ইঞ্জিনে ঘটঘট শব্দ শুরু হয়। বেলা তখন ৩টা। এমন শব্দ শোনার পরপরই কো-পাইলট ম্যাকমাহন বিমানটিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের এক হাজার ফুট ওপরে নামিয়ে আনলেন। তাতে মনে হলো, ইঞ্জিনটি এবার যেন একটু ভালোই চলছে।
এতে যে তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন সে সময়টুকুও পেলেন না। চোখের পলক ফেলার আগেই ডান দিকের ইঞ্জিনটা অচল হয়ে গেল। কী হলো? দেখা ও বোঝার আগেই বাম দিকেরটাও। নিঃশব্দ সমুদ্রের ওপর, নিজেদের ধাতব কম্পার্টমেন্টে বসে সিডনি ও ম্যাকমাহন যা শুনলেন, এ রকম পরিস্থিতিতে সব পাইলটই তা শুনে থাকে। ভয়াল নৈঃশব্দ্য! তারা ভাবলেন, এবার আমরা বুঝি ক্রাশ করতে যাচ্ছি।
এরপরের কয়েক মিনিট তারা পাগলের মতো অনেক কিছু করলেন। বিমানটি তখন দ্রুত নিচের দিকে নামছে। দুই পাইলট ফুয়েল পাম্প চেক করলেন, এর হাতল ধরে জোরে টান দিলেন। এভাবে করলে অনেক সময় বন্ধ ইঞ্জিন চালু হয়ে যায়। তবে কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। এরকম জরুরি পরিস্থিতিতে কী করতে হবে? তার যতটুকু জানা ছিল সে অনুযায়ী, ম্যাকমাহন উড়োজাহাজটির কন্ট্রোল ছেড়ে দিলেন উয়েমোতোর হাতে। উড়োজাহাজের ভেতরটা তখন গরম বাতাসে ভরে গেছে। তার হাত থেকে বাঁচতে ম্যাকমাহন ককপিটের দরজা খুলে দিলেন। এখন উড়োজাহাজটি সমুদ্রের পানিতে ডুবে গেলেও তারা আর ওটির ভেতরে আটকে থাকবেন না।
উড়োজাহাজটি যখন সমুদ্রের ৩০০ ফুটের মধ্যে চলে এসেছে, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে তার শেষ বার্তাটি দিলেন উয়েমোতো, ‘আমরা ২৫ মাইল উত্তর-পশ্চিম দিকে আছি। আমরা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছি।’ উয়েমোতো শক্ত হাতে বিমানের কন্ট্রোল চেপে ধরে আছেন। পাইলট স্কুলে তাদের শেখানো হয়েছে সমুদ্রে কীভাবে ফোর্স ল্যান্ডিং করতে হবে। তবে সেসব তো বইয়ের কথা, বাস্তবে যে এর প্রয়োগ করতে হবে, তা কে জানত? উয়েমোতোর বুঝতে বাকি রইল না যে তাদের বাঁচার আশা ক্ষীণ। কী করা যায়?
উয়েমোতো ভাবলেন, যদি উড়োজাহাজটিকে একটু বাঁকিয়ে সরাসরি পানির ওপর ফেলি তবে যে ধাক্কাটা খাবো তাতে আমরা দু’জনই মরব। আর যদি একটা পাখাকে প্রথমে পানির ওপর ধাক্কা দিতে দেই, তাহলে পুরো উড়োজাহাজটিই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তাহলে উপায়? উয়েমোতো এবার নিজেই নিজেকে বললেন, ‘এমনভাবে ল্যান্ড করো, যেন তুমি মাটিতে ল্যান্ড করছো’।
উড়োজাহাজটি যখন তীব্র গতিতে সমুদ্রের দিকে নামছিল, উয়েমোতো তখন জোর করে কল্পনা করতে থাকলেন, ওখানে পানির ওপর একটি রানওয়ে আছে। প্রবল বাতাস উয়েমোতোর কান দু’টিকে যেন বধির করে দিতে চাইল। সমুদ্র যেন এ সময় তাদের সঙ্গে ‘সাক্ষাতের’ জন্য ফুলে উঠছিল। একেবারে শেষ মুহূর্তে এক কাজ করে বসলেন উয়েমোতো। তিনি উড়োজাহাজের নাকটি একটু খাড়া করে দিলেন।
সব কিছু ঠিকমতোই হলো। প্রচণ্ড গতিতে উড়োজাহাজটি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিপুল পানি এসে উইন্ডস্ক্রিনকে ছাপিয়ে দিল। উয়েমোতো ও ম্যাকমাহন তাদের আসন থেকে ছিটকে পড়লেন। একটু পরেই চোখ খুললেন ম্যাকমাহন। বুঝলেন, অলৌকিকভাবে হলেও তিনি এখনো বেঁচে আছেন। ঠিক আছে, কিন্তু উয়েমোতো কোথায়? তাকিয়ে দেখেন তার পেছনেই লুটিয়ে আছেন উয়েমোতো। আহত ও রক্তাক্ত, কিন্তু সজ্ঞান।
উড়োজাহাজের খোলা দরজা দিয়ে হু হু করে পানি ঢুকছে। ম্যাকমাহন ভাবলেন, ‘বেঁচে যখন আছি তখন এখান থেকে বেরোতে হবে এবং একটুও দেরি করা চলবে না।’ তিনি দ্রুত সিটবেল্ট খুলে ফেললেন এবং সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন। এরপর উয়েমোতোর উদ্দেশ্যে চেঁচালেন, ‘বেরিয়ে এসো, সিডনি!’ ম্যাকমাহনের চিৎকার শুনে তার দিকে ক্লান্ত ও হতাশ চোখে তাকালেন উয়েমোতো। তার হাত তখনো উড়োজাহাজের কন্ট্রোলের ওপর। ম্যাকমাহন আবার ডাকলেন, ‘বেরিয়ে এসো!’
ডুবন্ত উড়োজাহাজের ভেতরে তখন হাঁটু পানি। যে কোনো মুহূর্তে ওটি সমুদ্রের পানিতে ডুবে যেতে পারে। ম্যাকমাহনের চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে পেলেন যেন উয়েমোতো। বললেন, ‘সমুদ্রে নামলে হাঙরে ধরবে না?’ ‘ওসব পরে। যা হবার হবে।’ বললেন ম্যাকমাহন। উয়েমোতো এবার দরজার দিকে এগোলেন। তার আগে নিয়ে নিলেন দুটো লাইফ জ্যাকেট। বেরিয়ে এসে উড়োজাহাজের পাখা ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওটি সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে গেল। সমুদ্র মুছে দিলো সব চিহ্ন, যেন ওখানে কখনোই কিছু ছিল না। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশিতে ভেসে রইল ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো দুটি মানবশরীর।
সমুদ্রে ভেসে থাকার লড়াই
সমুদ্র যেন ওদের অপেক্ষায় ছিল। পানিতে নামতেই ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে ওদের জড়িয়ে ধরল। পানির ছোঁয়া পেতেই ম্যাকমাহনের শরীর ও মনটা হঠাৎ শান্ত হয়ে এলো। ভাবল নিজের কথা আরে, আমি তো এই ওয়াহু এলাকারই ছেলে। সমুদ্রতীরে জন্মেছি, এর পানিতে খেলা করেছি, সার্ফিং করেছি, সাঁতার কেটেছি, নৌকা চালিয়েছি। এখন আমরা দু’জন একটু কষ্ট করে ভেসে থাকতে পারলেই হবে। কোস্টগার্ড তো জানেই কোথায় আছি আমরা। ওরা তো আসবেই।
উয়েমোতোর ভাবনাটা কিন্তু ম্যাকমাহনের ঠিক উল্টো। ভীষণ ভয় পেয়ে ভেঙে পড়েছেন তিনি। তাকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করলেন ম্যাকমাহন। ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে টুকটাক কথা বলতে থাকলেন তিনি। উয়েমোতোকে বললেন, ‘তোমার বাড়ির কথা বলো। তোমার ভাইবোন ক’জন?’ ‘আমার একটা বোন আছে’। হাবুডুবু খেতে খেতে বললেন উয়েমোতো। তারপর জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা, কোস্টগার্ড কখন আসবে?’ ‘ওরা এই এলো বলে। আমাদের ততক্ষণ ভেসে থাকতে হবে কষ্ট করে।’ জবাব দিলেন ম্যাকমাহন।
কয়েক ঘণ্টা পর ম্যাকমাহনের কথা ‘সত্য’হলো। আকাশে দেখা গেল মার্কিন নৌবাহিনীর একটি বিমান; পুরো এলাকায় চক্কর দিচ্ছে। বিমানটি ওরা দু’জনের ঠিক মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। ম্যাকমাহন তার লাইফ জ্যাকেট দুলিয়ে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল। তবে তাদের দিক থেকে দেখতে পাওয়ার পর কোনো ইশারা মিলল না, আগের মতোই চলতে থাকল এবং একটু পরেই দিগন্তে হারিয়ে গেল। পরের কয়েক ঘণ্টাও একের পর এক উড়োজাহাজ ওদের খোঁজে ওদেরই মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। ওরাও প্রাণপণ চেষ্টা করল উদ্ধারকারীদের চোখে পড়ার। তবে একটি উড়োজাহাজও কেন যেন তাদের দেখতে পেল না। এরপর কী হলো? থাকছে ২য় পর্বে। ডেইলি বাংলাদেশের সঙ্গেই থাকুন।
সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট