অজ্ঞান না করেই নির্মমভাবে ক্রীতদাসীদের ফিস্টুলা অপারেশন
বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অবদানের মধ্যে চিকিৎসাবিজ্ঞান যেন আশীর্বাদস্বরূপ। অতীতে মহামারীর কবলে পড়ে প্রতিষেধকের অভাবে হাজার হাজার মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যেত।
বিভিন্ন গবেষণা থেকেই এসব রোগকে নির্মূল করার উপায় বের করে মানুষ। ফলাফল হিসেবে মানুষ এখন অনেক কঠিন দূরারোগ্য থেকে বেঁচে ফিরছে, যেখানে পুরো কৃতিত্বই চিকিৎসাবিজ্ঞানের। তবে এতসব অবদানের বাইরে চিকিৎসাবিজ্ঞান এমন কিছু বিষয় নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে, যেগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ হওয়ার পর অমানবিকতার ট্যাগে ভূষিত হয়েছিল। জেনে নিন তেমনই কিছু অমানবিক গবেষণা সম্পর্কে-
থ্রি আইডেন্টিক্যাল স্ট্রেঞ্জার

থ্রি আইডেন্টিক্যাল স্ট্রেঞ্জার
সন্তানদের লালনপালন পদ্ধতির ফলাফল নিয়ে জানতে ১৯৬০ থেকে ৭০ এর দিকে একদল মনোবিজ্ঞানী একটি গোপন পরীক্ষার আয়োজন করেন। তারা সদ্য জন্মানো জমজ ও ত্রয়ীদের আলাদা করে বিভিন্ন পরিবারে দত্তক দেন। শিশুরা ভিন্ন ভিন্ন পরিবারে বেড়ে উঠতে থাকে। সবকিছু ঠিকঠাক মতোই যাচ্ছিল, কিন্তু ঝামেলা বাধে যখন ১৯৮০ সালে ত্রয়ীরা একে অপরকে খুঁজে পায়! তারা একে অপরকে দেখে অবাক হয়ে যায়, কীভাবে দুই পরিবারের দু’জন মানুষ দেখতে একরকম হতে পারে! তাদের সামনে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তখনো।কথাবার্তার একপর্যায়ে তারা সত্য উদঘাটনের সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর বেরিয়ে আসে তাদের একইরকম দেখতে হওয়ার রহস্য, তারা যে একই মায়ের সন্তান! জন্মের পর থেকে পুরো ২০ বছর তাদের আলাদা করে রাখা হয়েছিল শুধুমাত্র একটি গবেষণার জন্য। পরিবারের মানুষগুলো আবার নিজেদের সঙ্গে একত্রিত হয়। তবে ক্ষোভ, ঘৃণা আর হতাশায় একসময় বিচ্ছেদের কষ্ট মেনে নিতে না পেরে তিন ভাইয়ের একজন এডওয়ার্ড গ্যালেন্ড ১৯৯৫ সালে আত্মহত্যা করেন।
শিশুদের নিয়ে এই গবেষণা জনসম্মুখে চলে আসে এবং খবরের শিরোনাম হয়ে যায়। এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পিটার নিউবাউর এবং ভায়োলা বার্নার্ড। তারা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন,গবেষণাটির উদ্দেশ্য ছিল আলাদাভাবে বেড়ে ওঠা সন্তানরা কীভাবে নিজের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায় সেটা পর্যবেক্ষণ করা।
সবার মনে তখন একটাই প্রশ্ন এমন কিছু গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে কীভাবে? তবে আমেরিকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এই গবেষণায় অনুদান দিয়েছিল বলে জানা যায়। তবে তারা দাবি করেন, অর্থায়ন করলেও এরকম কোনো গবেষণার ব্যাপারে তাদের জানানো হয়নি। গবেষণাটির বিস্তারিত আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে, যে ফাইলগুলো ২০৬৬ সালের আগে খোলার ব্যাপার নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
নাৎসি ক্যাম্পের বীভৎসতা

নাৎসি ক্যাম্পের বীভৎসতা
জার্মানির কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মানুষ নিয়ে গবেষণাটি সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম। সময়টা ১৯৪০ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনী তখন অপরাজেয়। প্রতিনিয়ত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে মানুষদের ধরে আনা হচ্ছিল। বন্দিদের নিয়ে জোসেফ মেঙ্গেলা নামক এক চিকিৎসক ভয়ঙ্কর এক পরিকল্পনা করলেন। সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ এবং রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ফলাফল জানতে বন্দিদের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবেন বলে ভাবলেন তিনি।তারপর শুরু হলো অমানবিকতার এক নতুন যাত্রা। যেসব মানুষের উপর মেঙ্গেলা পরীক্ষা চালিয়েছেন তাদের ভেতর বেশিরভাগই ছিল ইহুদি। এছাড়াও রোমানি, সিনটি, পোলিশ এবং বিকলাঙ্গ জার্মান নাগরিকদের বাছাই করা হয়েছিল। তাদের উপর শুরু হয় মেডিকেল টর্চার, যার ফলশ্রুতিতে প্রথম পর্বেই অগণিত মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর ভেতর অনেকে বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেন, কেউ বা শরীরের নির্দিষ্ট অঙ্গ হারান। কিছু কিছু বন্দিকে অত্যধিক নিম্ন তাপমাত্রায় এবং নিম্নচাপের পরিবেশে রাখা হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল এরকম পরিবেশে জার্মান সৈন্যরা বেঁচে থাকতে পারে কি না সেটা যাচাই করা।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এই অমানবিক গবেষণার জন্য মেঙ্গেলা ও তার সহকারীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। তবে জোসেফ মেঙ্গেলা সুযোগ পেয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় পালিয়ে যান। এই গবেষণাটি সবচেয়ে বিতর্কিত হওয়ার কারণ এখানে নারী-পুরুষদের যেমন ব্যবহার করা হয়েছিল। তেমনি শিশুরাও বীভৎসতা থেকে রেহাই পায়নি! মেঙ্গেলা বহু মৃত মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করে রেখেছিলেন পরবর্তীতে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে।
মনস্টার স্টাডি

মনস্টার স্টাডি
১৯৩৯ সালে আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল স্পিচ প্যাথলজিস্ট ২২ জন এতিম শিশুর উপর একটি গবেষণা চালান, গবেষণার বিষয় ছিল ‘স্পিচ থেরাপি’। কথা বলতে সমস্যা হয় না এমন শিশুদের ভেতর একদলকে স্বাভাবিক কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার চর্চা করানো হয়। আর বাকিদের তোতলামো করার চর্চা করানো হয়। তোতলামো শেখানো বাচ্চাগুলো জন্মগতভাবে স্বাভাবিক হলেও তারা একসময় গিয়ে তোতলানো ছাড়া কথা বলতে পারছিল না। পরবর্তী জীবনে তোতলামো শেখা বাচ্চাগুলো আর স্বাভাবিক হতে পারেনি। তাদের সবাই সামাজিক কর্মকান্ডে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন এবং জীবনের ব্যাপারেও তাদের অনীহা লক্ষ্য করা গেছে।
এভাবে সুস্থ-স্বাভাবিক কতগুলো বাচ্চার উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর ব্যাপারটি ‘মনস্টার স্টাডি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু গোপন গবেষণাটির প্রধান ওয়েন্ডেল জনসন অবশ্য দাবি করেন, সামাজিক প্রেক্ষাপটে তোতলানো একজন শিশু যেসব বাধার সম্মুখীন হয়, সেগুলো দেখানোই এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল। এমন শিশুরা অন্যান্য স্বাভাবিক শিশু থেকে আবেগ, অনুভূতি প্রকাশে পিছিয়ে থাকে এবং নিজের ভেতর থেকে সাহস হারিয়ে ফেলে।গবেষকদল যে ব্যাখ্যাই দেন না কেন, বাস্তবে এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। সর্বশেষ ২০০১ সালে আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয় এতিম শিশুদের উপর চালানো গবেষণাটির জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে। তবে গবেষণার ফলাফল আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংরক্ষণ করে, যেহেতু ‘তোতলানো শিশুদের সামাজিক অবস্থান’ নিয়ে এর আগে বড় পরিসরে আর কোনো গবেষণা হয়নি।
ক্রীতদাসীদের উপর পরীক্ষা

ক্রীতদাসীদের উপর পরীক্ষা
আধুনিক গাইনিকোলজির জনক জেমস মেরিয়ন সিমস, তার হাত ধরেই সার্জারির নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হয়। ফিস্টুলার চিকিৎসায় তিনি নতুন সার্জারির ধারণা প্রবর্তন করেন, যে মেডিকেল টার্মটির সঙ্গে সন্তান জন্মের সময় বহু নারী পরিচিত হন। এছাড়াও তিনি ‘সিমস্ স্পেকুলাম’, ‘সিমস্ সিগময়েড ক্যাথেটার’সহ বেশ কিছু সার্জিক্যাল যন্ত্র আবিষ্কার করেন। তবে মেরিয়নের এত অবদান ছাপিয়ে তাকে যে জন্য বেশি স্মরণ করা হয় সেটা বেশ হৃদয়বিদারক। মেরিয়ন যখন একজন সার্জন ছিলেন সেই সময় অপারেশনের কাজে এনেস্থেসিয়ার ব্যবহার নতুনই বলা চলে।এটা ব্যবহার করা হয় যাতে অপারেশন চলাকালে একজন রোগী ব্যথা থেকে মুক্তি পায়। মেরিয়ন তখনো এই জিনিসে অভ্যস্ত হতে পারেননি। তাই এনেস্থিসিয়া ছাড়াই সার্জারি চালিয়ে যেতে লাগলেন। আর ফিস্টুলার অপারেশনগুলো করার জন্য তিনি সবসময় আফ্রিকান ক্রীতদাসীদেরই বেছে নিতেন। প্রকৃতপক্ষে, এই প্রক্রিয়া প্রচণ্ড বেদনাদায়ক হলেও মেরিয়ন ১৮৫৭ সালের এক বক্তৃতায় দাবি করেন, ফিস্টুলার অপারেশন চলাকালীন যে ব্যথা তৈরি হয় সেটা খুবই সামান্য! যার কারণে তিনি এনেস্থিসিয়া ব্যবহারের বিরুদ্ধে, যদিও তার এই বক্তব্য অধিকাংশ মানুষই মেনে নেয়নি।
একজন সার্জনের জন্য গবেষণা চালানোর ব্যাপারে আফ্রিকান ক্রীতদাসীদের মতো সহজসাধ্য বিষয় আর কিছু হয় না। নতুন একটি পদ্ধতি যাচাই না করেই আফ্রিকান নারীদের উপর প্রয়োগ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? এর উত্তর দিয়েছেন আলবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্মের অধ্যাপক দুরেন্দা ওঝানুগা। তিনি ১৯৯৩ সালে জার্নাল অব মেডিকেল এথিকস-এ লিখেন, দাসত্বপ্রথার সুযোগ নিয়ে সিমস্ এমন একটি স্পর্শকাতর গবেষণায় কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন, যা কোনো মানদণ্ডেই মানবিক আচরণ হতে পারে না।
স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট

স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট
=১৯৭১ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মনোবিজ্ঞানী চিন্তা করলেন, প্রতিকূল পরিবেশে থাকা অবস্থায় একজন ভালো মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন হয় সেটা পর্যবেক্ষণ করবেন। এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন প্রফেসর ফিলিপ জিম্বার্ডো, তার কথামতো একদল কলেজ পড়ুয়াকে একটি মজার পরীক্ষায় অংশ নিতে রাজি করানো হয়। যেখানে একটি নকল জেলখানা থাকবে এবং ছাত্ররা দু’ভাগ হয়ে অফিসার ও কয়েদির ভূমিকা পালন করবে।
প্রথমদিকে সবাই যতটা উৎসাহ সহকারে খেলায় মেতে উঠেছিল, সেটা কিছুদিন না যেতেই ভয়ানক রূপ লাভ করে। কারণ যাদের অফিসারের ভূমিকায় রাখা হয়েছিল তারা কয়েদি ভূমিকায় অভিনয় করাদের উপর নানা শারীরিক, মানসিক নির্যাতন চালাতে শুরু করে। তবে এটা করার ব্যাপারে তাদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। আর যাদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছিল তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং নিজেকে একদম নিরূপায় হিসেবে আবিষ্কার করে। যদিও তারা বাস্তবের কোনো জেলখানায় ছিল না! অন্যদিকে তাদের নির্যাতন করতে-করতে অফিসার ভূমিকায় অভিনয় করাদের ভেতর এক ধরণের কাঠিন্য ও নির্লিপ্তভাব চলে আসে।
গবেষণাটি দু’সপ্তাহব্যাপী চলার কথা থাকলেও মাত্র ৬ দিনের মাথায় গবেষকদল নিজেদের কাজে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। তবে এই ক’টা দিনই তাদের গবেষণা ফলাফল পাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। একদল ভালো মানুষ কীভাবে ভিন্ন পরিস্থিতিতে পড়লে আচরণ বদলে ফেলে, এই গবেষণাটি সেটাই ইঙ্গিত করে। যদিও কলেজ পড়ুয়াদের উপর চালানো এরকম গবেষণার ফলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল এবং অনেকটা সময় লেগেছে নিজেদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে।
সূএ : ডেইলি বাংলাদেশ