গ্রেডিং পদ্ধতিতে আসছে আমূল পরিবর্তন
দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। ২০২১ সালের মধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাগভিত্তিক ও গ্রেডিং পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন এনে প্রতিটি স্তরে শিক্ষাদান পদ্ধতি ও ফল মূল্যায়নকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে চায় সরকার। এজন্য ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ থেকেই পুরোদমে কাজ শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রথম ধাপ হিসেবে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত দেশের প্রতিটি ধাপের পাবলিক পরীক্ষায় গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ বা জিপিএ’র সর্বোচ্চ মান ৫ থেকে কমিয়ে ৪ করতে চায় সরকার। এ বিষয়ে দেশের নামকরা শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও উপাচার্যরাও শিক্ষা ব্যবস্থার নীতিনির্ধারকদের একই পরামর্শ দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষ করে ইউরোপীয় এবং উত্তর আমেরিকান শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যই জিপিএ মান চারে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এজন্য ২০১৯ সালের শুরু থেকেই কাজ করা হচ্ছে। বর্তমান জিপিএ মান বহির্বিশ্বের সঙ্গে খাপ না খাওয়ায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়তে গিয়ে বড় সমস্যায় পড়েন। এছাড়া চাকরির সময় জিপিএ সমমান করতে সমস্যা হয় তাদের। অষ্টম শ্রেণিতে নেয়া জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা জেএসসি পরীক্ষা থেকেই জিপিএ ৪ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করে এর সমাধান করতে চায় সরকার।
বর্তমানে ফল মূল্যায়ন পদ্ধতিটি জিপিএ নামে ২০০১ সালে চালু হয়। যেখানে ৮০ থেকে ১০০ নম্বরে গ্রেড-৫, ৭০ থেকে ৭৯ নম্বরে-৪, ৬০ থেকে ৬৯ নম্বরে- ৩.৫০, ৫০ থেকে ৫৯ নম্বরে-৩, ৪০ থেকে ৪৯ নম্বরে-২, ৩৩ থেকে ৩৯ নম্বরে-১ এবং শূন্য থেকে ৩২ নম্বরে গ্রেড পয়েন্ট শূন্য ধরা হয়। লেটার গ্রেডে যথাক্রমে এ প্লাস, এ, এ মাইনাস, বি, সি, ডি এবং এফ গ্রেড। লেটার গ্রেড ১ পেলে পাস এবং এফ গ্রেড পেলে অনুত্তীর্ণ ধরা হয়।
তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই গ্রেডিং পদ্ধতিটি আবার আলাদা। কোনো বিষয়ে ৮০-এর ওপরে নম্বর পেলে সিজিপিএ ৪, ৭৫ থেকে ৮০ নম্বরে ৩.৭৫, ৭০ থেকে ৭৫ নম্বরে ৩.৫০, ৬৫ থেকে ৭০ নম্বরে ৩.২৫, ৬০ থেকে ৬৫ নম্বরে ৩, ৫৫ থেকে ৬০ নম্বরে ২.৭৫, ৫০ থেকে ৫৫ নম্বরে ২.৫০, ৪৫ থেকে ৫০ নম্বরে ২.২৫, ৪০ থেকে ৪৫ নম্বরে ২ এবং ৪০ নম্বরের কম পেলে অনুত্তীর্ণ ধরা হয়। লেটার গ্রেডে যথাক্রমে এ প্লাস, এ, এ মাইনাস, বি প্লাস, বি, বি মাইনাস, সি প্লাস, সি এবং ডি। এফ গ্রেড মানে অনুত্তীর্ণ।
প্রস্তাবিত নতুন পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ৯০ থেকে ১০০ পর্যন্ত এ প্লাস বা জিপিএ ৪, ৮০-৮৯ পর্যন্ত এ, ৭০-৭৯ বি প্লাস, ৬০-৬৯ বি, ৫০-৫৯ সি প্লাস, ৪০-৪৯ সি, ৩৩-৩৯ ডি এবং শূন্য থেকে ৩২ পর্যন্ত এফ বা অকৃতকার্য নির্ধারণ করা হয়েছে। জেএসসি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এই একই গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করা হবে। গ্রেড পদ্ধতির এই পরিবর্তনকে দারুণ একটি বিষয় বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, ‘বৈশ্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে গ্রেড পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা হচ্ছে। এটি অনেক বড় একটি কাজ। সামান্য ভুল হলেও অনেক বড় ভুল হয়ে যাবে। এজন্য আমরা কিছুটা ধীরে এগোচ্ছি। ব্যবস্থা বদলে দেয়ার ফলে কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটিও আমাদেরকে ভাবতে হবে।’
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যেসব ফাঁকফোকর রয়েছে, আমরা সেটি পূরণ করতে চাচ্ছি। এরই অংশ হিসেবে গ্রেডিংয়ে পরিবর্তন আনা হচ্ছে।’
মাধ্যমিক শিক্ষায় বিভাগ বিভাজন বন্ধ হবে
আরো একটি বদল আসছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। নবম শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগের বিভাজন না রাখার পরিকল্পনা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যেখানে নবম ও দশম শ্রেণিতে সবাইকে একই শিক্ষাক্রমে একই পাঠ্যবই পড়িয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য গড়ে তোলা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে হবে বিভাগ বিভাজন।
এ বিষয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই পদ্ধতি চালু করা গেলে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরে সব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারবে। পরবর্তী শিক্ষা স্তরগুলোতে এটি শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক বেশি সহায়ক হবে। যেসব পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের শিক্ষা পদ্ধতির চেহারা আমূল বদলে যাবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নবম-দশম শ্রেণিতে পাঠ্যক্রম বদলে গেলে পাঠবইও বদলে ফেলা হবে। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রম সমন্বয় করে পরিবর্তন করা হবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, ২০২১ সাল থেকে নতুন পাঠ্যক্রম অনুসারে প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে বই বিতরণ করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরপরের বছর প্রাথমিকে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি ও মাধ্যমিকে সপ্তম, নবম ও একাদশ শ্রেণির পাঠ্যবই বদল করা হবে। ২০২৩ সালে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবইও পরিবর্তন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, এখনো পর্যন্ত প্রচলিত পাঠ্যবইগুলোকে কিভাবে আরো যুগোপযোগী করে তোলা যায়, সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হবে। আমাদের সন্তানরা যেন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়ে সেটিই আমাদের লক্ষ্য। এজন্য পাঠ্যগ্রন্থ বিশারদদের সঙ্গে আলোচনা করে পাঠ্যসূচিও তৈরি করা হচ্ছে।
কমবে পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা
নতুন পাঠ্যক্রমে পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে আনার পরকিল্পনাও মন্ত্রণালয়ের হাতে রয়েছে। পরীক্ষা কমিয়ে আনতে চলতি শিক্ষাবর্ষেই পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি শ্রেণিতে চালু করা হয় ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতি। এতে ভালো ফল পাওয়ায় আগামী বছর থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার বদলে ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা হবে। ২০২০ সালে প্রথম দফায় ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এবং পরবর্তীতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এটি চালু করা হবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর বা মাউশি সূত্রে জানা গেছে, পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে আনতে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়নের পরিমাণ বাড়ানো হবে। শ্রেণিকক্ষে সব বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নে ২০ নম্বর রাখা হবে। বর্তমানে গার্হস্থ্য অর্থনীতি ও কৃষি বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে যুক্ত হবে সব বিষয়।
দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, শিক্ষা পদ্ধতি বদলে দিতে হলে যুগের চাহিদা ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। এখন যারা সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন, আমি মনে করি তারা দূরদর্শী মানুষ। গ্রেডিং পদ্ধতি, বিভাগ বিভাজন ও পরীক্ষা কমিয়ে এনে ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালুর পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে।