হিটলারকে লেখা গান্ধীর দুই চিঠি, যা কখনোই পৌঁছায়নি
হিটলার ও গান্ধী, পৃথিবীর দুই মেরুর মানুষ তারা দুজন। একজন বিশ্বাস করতেন অহিংস মতবাদে। তাইতো তিনি অহিংস আন্দোলনে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। আর অন্যজন প্রবল জাত্যভিমানী ও আর্য শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাসী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে খলনায়ক হয়ে কেড়ে নিয়েছেন অসংখ্য মানুষের প্রাণ।
তবে আশ্চর্যজনকভাবে হলেও সত্য, যুদ্ধবাজ জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে ছিল তার দারুণ সখ্য। ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। অনেকে হয়ত অবাক হবেন জেনে, মহাত্মা গান্ধী বিশ্বযুদ্ধ এড়াতে হিটলারকে চিঠি লিখেছিলেন। একবার নয় দুবার। চিঠিতে হিটলারকে সম্বোধন করেছিলেন ‘প্রিয় বন্ধু’ হিসেবে। তবে তার ওই চিঠি হিটলারের কাছে পৌঁছেনি। ভারতের জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর এই চিঠি কখনোই পৌঁছাতে পারেনি।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ১৯৩৯ সালে, জার্মান বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণের মাস খানেক আগে বন্ধু হিটলারকে চিঠি লেখেন মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু তখনকার ব্রিটিশ সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে চিঠিটি কখনোই প্রাপকের হাতে পৌঁছায়নি। এটি লেখার ৩৮ দিন পর ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলারের নির্দেশে পোল্যান্ড আক্রমণ করে জার্মান বাহিনী।
বিপরীত মতাদর্শের হওয়ায় অনেকেরই আগ্রহ আছে কি ছিল গান্ধীর সেই চিঠিতে? চলুন তবে জেনে নেয়া যাক সেই চিঠিতে কি লিখেছিলেন মহাত্মা গান্ধী-
১ম চিঠি
মহাত্মা গান্ধী হিটলারকে প্রথম চিঠিটি লেখেন ১৯৩৯ সালের আগস্টের ২৩ তারিখে। তার আট দিন পরেই জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে।
প্রিয় বন্ধু,
মানবতা রক্ষায় আপনাকে কিছু লেখার জন্য বন্ধুরা আমাকে তাগাদা দিচ্ছিল। কিন্তু আমি তাদের অনুরোধে বাধা দেই, কারণ মনে হচ্ছিল তা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করবে। কোনো কারণে অনুভব করছি ,আমার হিসেব-নিকেশ করা উচিত হবে না এবং আমি অনুরোধ জানাতে পারি, তা যেমনভাবেই মূল্যায়িত হোক না কেন।
এটা স্পষ্ট যে আজ আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি যুদ্ধ থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারেন, যুদ্ধ রাষ্ট্রের জন্য মানবিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। একটি বস্তু আপনার জন্য যেমন মূল্যবানই হোক না কেন তার জন্য কি শোধ তুলে ছাড়বেন? আপনি কি এমন একজনের কথা শুনতে চান, যিনি স্বেচ্ছায় যুদ্ধ এড়িয়ে চলছেন দৃশ্যমান কোনো সফলতা ছাড়াই? যাইহোক লেখায় যদি আমি কোনো ধৃষ্টতা দেখিয়ে থাকি, আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
আপনার নিকটতম বন্ধু
এম.কে. গান্ধী
২য় চিঠি
দ্বিতীয় চিঠিটি হিটলারকে গান্ধী লেখেন ২৪ ডিসেম্বর ১৯৪০ সালে। ততদিনে বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। এই চিঠিটি ছিল আগেরটির চেয়ে অপেক্ষাকৃত বড়। চিঠির শেষে ওঠে এসেছে হিটলারের সঙ্গে জোট গড়া ইতালির ফ্যাসিস্ট বেনিতো মুসোলিনির প্রসঙ্গও। যুদ্ধের আসন্ন পরিণাম সম্পর্কে গান্ধী হিটলারকে সতর্ক করেছিলেন চিঠিতে।
প্রিয় বন্ধু,
আপনাকে আমার বন্ধু সম্বোধন শিষ্টাচারের খাতিরে নয়। কেউই আমার শত্রু না। বিগত ৩৩ বছর ধরে আমি জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে পুরো মানুষ জাতির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছি। আমি আশা করছি, আপনার জানার সময় ও ইচ্ছা হবে মানবজাতির একটি শুভ অংশ কিভাবে আপনার ধারণার প্রভাবে ঘটতে থাকা ঘটনায় জীবন-যাপন করছে।
জন্মভূমির জন্য আপনার ত্যাগ ও সাহসিকতা নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিপক্ষ যেভাবে আপনাকে দানব আখ্যা দিচ্ছে, তাও আমরা বিশ্বাস করি না। কিন্তু আপনার, আপনার বন্ধু ও গুনগ্রাহীদের লেখা ও ঘোষণাগুলো সন্দেহের বাকি রাখেনি যে, আপনার অনেক কাজই মানবিকতার জন্য অশুভ ও দানবীয়। বিশেষ করে আমার মতো যারা বিশ্ব ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাস করছি তাদের জন্য।
যুগোস্লাভিয়াকে নাকাল করা, পোল্যান্ডকে ধর্ষণ ও ডেনমার্ককে দখলে নেওয়া; এসব ধ্বংসযজ্ঞ আপনার কাছে মহৎ কাজ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের ছেলেবেলা থেকে শেখানো হয়েছে, এসব মানবতার জন্য অবমাননাকর।
সম্ভবত আমরা আপনার সেনাবাহিনীর সফলতা চাইতে পারি না। তবে আমাদের অবস্থান স্বতন্ত্র। ব্রিটিশ উপনিবেশকে আমরা নাৎসিদের চেয়ে কম প্রতিরোধ করি না। পৃথিবীর পাঁচ ভাগের একভাগ মানুষকে ব্রিটিশ শাসনের কবলে নিয়ে আসা হয়েছে, যা আসলে কোনো নিরীক্ষণ প্রক্রিয়াকে মেনে নেয় না।
আমাদের প্রতিরোধ ব্রিটিশদের ক্ষতি করা নয়। আমরা তাদের বদলাতে চাই। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত করতে নয়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ নিরস্ত্র। আমরা তাদের বদলাতে পারি কিংবা না পারি; অহিংস আন্দোলনের মধ্যে তাদের শাসন এখানে অসম্ভব করতে বদ্ধ পরিকর।
এ অহিংস পদ্ধতি বলপ্রয়োগ করা যায় না। এই বোধ ধারণা দেয় নির্যাতনকারীরা তাদের অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করতে পারে না; যদিনা ভুক্তভোগীদের নূন্যতম ইচ্ছা, সহযোগিতা ও বাধ্যবাধকতা থাকে। শাসকরা আমাদের দেহকে ভুগাচ্ছে ও ভূমি দখল করেছে তবে আমাদের সত্ত্বা নয়। প্রতিটি ভারতীয় নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করে তারা কিছুই পাবে না। হয়ত সবাই সে ধরনের রকম সাহসিকতা দেখাবে না; ভয়ের কারণে বিদ্রোহ পিছু হটতে পারে, তা সত্য। তবে তা অন্য আলোচনা।
যদি উল্লেখযোগ্য নারী ও পুরুষ পাওয়া যায়, যারা জীবন উৎসর্গ করতে পারবে; নিপীড়নকারীদের কাছে দয়া-প্রার্থনা না করে। স্বৈরাচারের সহিংসতা থেকে তারা স্বাধীনতার স্বাদ পেতে পথ দেখবে। আমি চাই আপনি বিশ্বাস করুন এ ধরনের অপ্রত্যাশিত সংখ্যক মানুষ রয়েছেন ভারতে। গত ২০ বছর ধরে তারা এভাবে নিজেদের গড়ে তুলেছেন। গত ৫০ বছর ধরে আমরা ব্রিটিশদের হটাতে চাইছি। স্বাধীনতার আন্দোলন আগে কখনোই এতটা শক্তিশালী ছিল না।
এখানে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস যেটিকে চূড়ান্ত পরিণতিতে নিয়ে যেতে চাইছে। আন্দোলনের অহিংস চেষ্টায় আমরা উল্লেখযোগ্য সফলতা পেয়েছি। সবেচেয়ে সংঘবদ্ধ ব্রিটিশ সহিংসতার বিরুদ্ধে আমরা সবচেয়ে সঠিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি।
এখন আপনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। দেখার বাকি জার্মান ও ব্রিটিশদের মধ্যে কোনটি বেশি সংঘবদ্ধ। আপনি জানেন ব্রিটিশদের শেষটা আমাদের জন্য এবং সারাবিশ্বে অ-ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠীদের জন্য কিরূপ অর্থ বহন করে। কিন্তু জার্মানির সহযোগিতায় তাদের শাসনের অবসান হউক তা আমরা চাই না।
আমরা অহিংস পথ খুঁজে নিয়েছি। অহিংস প্রক্রিয়ায় পরাজয় বলে কিছু নেই। এটি হলো কাউকে হত্যা বা আহত না করেই ‘করো অথবা মরো’ পন্থা অবলম্বন করা। অর্থ ও বিজ্ঞানের ধ্বংসযজ্ঞ ব্যবহার না করেই যেটির বাস্তবায়ন সম্ভব। এই অলৌকিক ব্যাপারটি কারও করায়ত্তে নেই।
যদি ব্রিটিশরা না পারে, অন্যকোনো শক্তি নিজেদের সক্ষমতা বাড়াবে ও আপনাদের পরাজিত করবে। আপনারা এমন কোনো চিহ্ন রেখে যাচ্ছেন না, যাতে আপনার দেশের জনগণ গর্ববোধ করতে পারে। দক্ষভাবে পরিকল্পিত কোনো হত্যাযজ্ঞের প্রশংসা তারা নিতে পারে না।
আমি আপনার কাছে অনুরোধ করি মানবতার খাতিরে এই যুদ্ধ থামানোর জন্য। আপনি ও যুক্তরাজ্য বিবাদমান বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বা যৌথ উপায় নিষ্পত্তি করলে, আপনি কিছুই হারাবেন না। যদি যুদ্ধে জিতেও যান, তাতেই প্রমাণ হয় না আপনি সঠিক। এটা শুধু বলবে আপনার ধ্বংসর ক্ষমতা বেশি।
একটি পক্ষপাতহীন ট্রাইব্যুনাল মানবিকভাবে যাচাই করুক কোনপক্ষ সঠিক। খুব বেশিদিন হয়নি আমি আবেদন জানিয়েছিলাম ব্রিটেনবাসী যেন আমার পন্থা গ্রহণ করে, আপনি সে বিষয়ে জানেন। আমি বিদ্রোহী হলেও ব্রিটিশরা আমাকে বন্ধু ভাবে তাই বলেছিলাম। তবে আমি আপনার ও আপনার দেশের জনগণের কাছে অপরিচিত। ব্রিটিশদের জন্য আমি যে আহ্বান জানিয়েছি তা আপনাকে বলার স্পর্ধা আমার নেই। এটা একইভাবে কাজও করবে না। বাস্তবিকতা বিবেচনায় আমার বর্তমান প্রস্তাবটি তাই সহজ।
এই সময় যখন ইউরোপবাসী শান্তির জন্য আরও বেশি একাগ্র, এমনকি আমরাও আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন স্থগিত করেছি। ব্যক্তিগতভাবে এটি হয়ত আপনার কাছে অর্থবহন করে না। শান্তির জন্য আপনার কাছে এটুকু চেষ্টা চাওয়া কি খুব বেশি? লাখ লাখ ইউরোপীয় শান্তির জন্য বোবাকান্না কেঁদে যাচ্ছে, যা আমিও শুনতে পাচ্ছি।
আপনি ও মুসোলিনিকে যৌথভাবে আমি এই আবেদন জানাতে চেয়েছি, একটি সম্মেলনে তার সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল, ইংল্যান্ড থেকে রোম সফরকালে। আমি আশা করব, পরিবর্তন কামনা করে তিনি এই আহ্বান গ্রহণ করবেন।
আপনার নিকটতম বন্ধু
এম.কে. গান্ধী