মৃতদেহকে ‘অপবিত্র’ ভেবে সাজিয়ে খেতে দেয়া হয় শকুনদের
মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই মৃত ব্যক্তির সৎকার করা হয়। বহু প্রাচীন ও প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী মৃতদেহকে কবর দেয়া বা শ্মশানে চিতায় পুড়িয়েই সৎকার করা হয়ে থাকে। তবে জানেন কি? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মৃতদেহ সৎকার নিয়ে রয়েছে নানান অদ্ভুত রীতিনীতি। এর বেশ কিছু যেমনই অদ্ভুত, তেমনই বীভৎসও বটে।
ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণ সুলাওয়েসির তোরাজা গ্রামবাসীরা মারা যাওয়ার পর মৃতদেহকে বিশেষ উপায়ে তারা মমি করে সমাহিত করে। আবার, ভেনেজুয়েলার ইয়ানোমামি গোত্রের লোকেরা মৃতদেহকে সিদ্ধ করে স্যুপ হিসেবে খেয়ে থাকে। ফিলিপাইনের ইফুগাও অঞ্চলের মানুষেরা মৃতদেহকে বাড়ির সামনে সাজিয়ে রাখে। বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী লোকজন এই নিয়ম-কানুন অত্যন্ত বিশ্বাস ও সম্মানের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে পালন করে আসছে, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যা বর্তমান।
মৃতদেহ নিয়ে এমনই এক অদ্ভুত প্রথা প্রচলিত রয়েছে পার্সি সমাজের মানুষের মাঝে। পার্সি ধর্মাবলম্বীদের প্রথা অনুসারে, তাদের কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু হলে তারা মৃতদেহের সৎকার করেন না। মৃতদেহ কবর দেয়া বা পুড়িয়ে ফেলার সংস্কারেও তারা বিশ্বাসী নয়। মৃতদেহ খোলা স্থানে রেখে দেয়াই যেন এক ধর্মীয় রীতি। পার্সি বা জরথ্রুষ্টিয়ান বা জোরাস্ট্রিয়ানরা এই ধর্মীয় রীতিনীতিতে বিশ্বাসী। তারা মৃত্যুর পরে দাহ বা সমাধি‚ কোনোটিই করে না। উঁচু এক মিনারে মৃতদেহ রেখে দেয়াই তাদের সৎকার। সেই দেহ ভক্ষণ করে শকুনের দল। তাতেই নাকি মৃত ব্যক্তির সমস্ত পাপ মোচন হয়।
কেন এই বিশ্বাসের পথিক পার্সিরা?
ভারতীয় উপমহাদেশে এটি পারসিক বা পার্সি ধর্ম নামেও পরিচিত। ধর্মটি বহু প্রাচীন। ঐতিহাসিকদের মতানুসারে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৫৮ সাল থেকে এই ধর্মের প্রচলন শুরু হয়। জরথ্রুস্ট এমন একটি ধর্ম, যা একসময় প্রাচীন ইরানের একামেনিড, পার্থিয়ান, সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের জাতীয় ধর্ম ছিল। বর্তমানে ধর্মটি আধুনিক ইরানের জরথ্রুস্ট সম্প্রদায় এবং ভারতের পার্সি সম্প্রদায় কর্তৃক পালিত হয়।
জরথ্রুস্টবাদে, পানি (আপো, আবান) এবং আগুন (আতার, আযার) হলো ধর্মীয় পবিত্রতার প্রতিনিধি। এ সম্পর্কিত শুদ্ধিকরণের আচার-অনুষ্ঠানসমূহকে ধর্মীয় জীবনব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পার্সি ঐতিহ্য অনুসারে মৃতদেহকে অপবিত্র ভাবা হয়। এ কারণে পানিতে মৃতদেহ ভাসিয়ে দেয়া বা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা এ ধর্মে একদম নিষিদ্ধ। কারণ মৃতদেহকে কবর দেয়া বা পোড়ানো অর্থ প্রকৃতিকে দূষিত করা বলেই পার্সিদের বিশ্বাস।
তাছাড়া প্রাচীন ইরানিদের বিশ্বাস ছিল‚ মৃত্যুর পর না-কি দেহে প্রবেশ করে অশুভ আত্মা। অশুভ হয়ে যায় পারিপার্শ্বিক। তাই পার্সিদের শব রেখে দেয়া হয় উঁচু সৌধে। ইরানে যখন এই সৌধ যথেষ্ট ছিল না‚ পর্বত শিখরে রেখে আসা হত মানুষের নিথর দেহ। পড়ে থাকা শব ভক্ষণ করত শকুনের ঝাঁক। পড়ে থাকত হাড়গোড়। এক বছর ধরে তা রোদে শুকানো হত। তারপর তা ব্যবহৃত হত কৃষিকাজের সার হিসেবে।
এই রীতির নেপথ্যে…
আপাত নৃশংস হলেও পার্সিদের এই রীতির নেপথ্যে আছে বাস্তবসম্মত কারণ। আর তা হলো মিতব্যয়িতা। এতে কোনো জ্বালানি লাগে না। সমাহিত করার ব্যয়ও নেই। ফলে খরচ কম। তাছাড়া‚ এতে ধনী-দরিদ্র বিভাজনও ধরা পড়ে না। পার্সিদের অন্ত্যেষ্টির এই রীতিকে অনেকেই বলেন ‘গ্রিনেস্ট ওয়ে’। এর ফলে জ্বালানির নিধন হয় না। বিলুপ্তপ্রায় শকুনদের খাবারের যোগান হয়। একে একদিকে পার্সিরা সেবা হিসেবেও দেখেন। অর্থাৎ নশ্বর দেহ দিয়ে প্রাণীদের সেবা।
মৃতদেহকে টাওয়ার অব সাইলেন্সে রেখে আসার পক্ষে পার্সি ধর্মাবলম্বীদের যুক্তি ছিলো ভিন্ন। পাঁচ হাজার বছর পূর্বে পৃথিবীতে এমন এক সমাজ ছিল যেখানে গোর খননের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কবর না দেয়ার কারণে মৃতদেহ পঁচে যাতে জীবিত মানুষকে অসুস্থ ও জীবাণু আক্রান্ত করতে না পারে সেজন্য মৃতদেহকে সমাজ থেকে দূরে কোথাও ফেলে আসার ব্যবস্থা করা হয়। এ ব্যবস্থা অনুসরণের মধ্য দিয়ে সমাজের কোনো বিনাশ না ঘটিয়ে মৃতদেহকে পশু পাখিদের ভক্ষণের জন্য রেখে আসাটাই ছিল সৎকারের নিয়ম। এরপর থেকেই লোকাচারের সূচনা এবং তা পরবর্তীতে পার্সিদের ধর্মীয় ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়ে।
টাওয়ার অব সাইলেন্সে দল বেঁধে বসে থাকে শকুনের দল। সৎকারে আসা মানুষদেরকে অবশ্য তারা কখনো আক্রমণ করে না। তবে বর্তমানে শকুনের সংখ্যা কমেছে। ফলে নৈঃশব্দ্যের মিনারে জমে থাকা মৃতদেহের সদ্ব্যবহার করার জন্য কেউ থাকে না। থেকেই যায় পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা। এই মিনার থেকে যাতে বৃষ্টির পানি বাইরে বেরিয়ে না আসতে পারে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে। ওই পানি চলে যায় মাটির নীচে গভীর কুয়ায়।
টাওয়ার অব সাইলেন্স
ছাদবিহীন সুউচ্চ কাঠামো। এটিই টাওয়ার অব সাইলেন্স। এর নিচে একটি দরজা রয়েছে এবং ভিতরে রয়েছে কয়েকটি তাঁক। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে এবং নানা রীতিনীতির মাধ্যমে পার্সি পরিবারগুলো তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহকে ওইসব তাঁকে রেখে আসেন। পরে ওই স্থানে মৃতদেহ রেখে দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। অন্য কোনো মৃতদেহ রাখার জন্য বা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া দরজাটি আর খোলা হয় না।
টাওয়ার অব সাইলেন্সে তিনটি গোলাকার অংশ রয়েছে মৃতদেহ রাখারা জন্য তিনটি অংশ। এক অংশে পুরুষের মৃতদেহ রাখা হয় অন্যটিতে নারীদের ও আরেকটি অংশে রাখা হয় শিশুদের মৃতদেহ। খোলা ছাদ দিয়ে চিল, শকুন ইত্যাদি পাখি ভিতরে প্রবেশ করে মৃতদেহ খেতে আরম্ভ করে। আর এ প্রথার মাধ্যমে মৃতদেহ পৃথিবীকে উৎসর্গ করে সেখান থেকে ফিরে যান মৃতের পরিবারের লোকজন। আর তারপর সেই মৃতদেহের কী পরিণতি হয় তা তো সবারই জানা।
যতদূর শোনা যায় এই টাওয়ার অব সাইলেন্সে মানুষের যাতায়াত একেবারেই নেই বললেই চলে। কোনো পার্সিয়ান মারা গেলে শুধুমাত্র তখনই ওই পরিবারের নিকট আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতি চোখে পড়ে এই স্থানটিতে। মৃতদেহ রাখতেই পার্সি পরিবারগুলো হাজির হয় সেখানে। মৃতদেহ প্রকৃতিকে উৎসর্গ করে সেখান থেকে ফিরে যান মৃতদেহের পরিবারের লোকজন। এভাবে মৃতদেহকে পশুপাখির উদ্দেশ্যে রেখে আসার মধ্য দিয়ে পার্সি ধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরা প্রকৃতিকে কিছু ফিরিয়ে দেন। আর এভাবেই তারা জীবনের সার্থকতা খুঁজে নেন। এমনতর বিশ্বাসে তারা বংশ পরম্পরায় মৃতদেহকে প্রকৃতির মাঝে ফেলে আসেন।
ভৌতিকতা
শোনা যায়, দিনের বেলাতেও এই টাওয়ার এত চুপচাপ থাকে যে পাতা পড়ার সামান্যতম আওয়াজেও আপনি চমকে উঠতে বাধ্য। ভাবতে পারেন কেউ বুঝি আপনাকে অনুসরণ করছে। ভারতের মুম্বাইয়ের মালাবার পাহাড়ের কাছে পার্সিদের এমনি এক টাওয়ার অব সাইলেন্স রয়েছে যা কেবল অগুণতি মৃতদেহের অবস্থানের কথা জানান দেয়। মুম্বাইয়ের মতো এত জনবহুল শহরেও মৃতদের এমন ডেরার কথা জানলে চমকে উঠতেই পারেন! মৃতদের এই ডেরায় দিনের বেলাতেও অনেকে একা যেতে সাহস পান না।
মৃতের সৎকার করা মোটেও শুধুমাত্র মৃতব্যক্তির জন্য নয়, বরং সেটা জীবিতের প্রয়োজনে। তাকে মাটি চাপা দেয়া, তাকে পুড়িয়ে ফেলা কিংবা নির্জন কোনো ভাগাড়ে ফেলে আসা এসবই করা হয় বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কার হিসেবে। তবে এসব কাজের পেছনে জীবিত মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবা হয়। কোনো সৎকার প্রক্রিয়াই আসলে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার সুবিধা ও সুযোগের বাইরের কিছু নয়।