সাত বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে লটারিও জিতেন ভাগ্যবান এই ব্যক্তি
ট্রেনে চেপে তিনি যাচ্ছিলেন গন্তব্যে। পেশায় তিনি একজন গানের শিক্ষক। সারায়েভো থেকে ডুবরোভনিকে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎই ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে বরফে ঢাকা এক নদীর উপরে ছিটকে পড়ে।
ঘটনাস্থলেই নিহত হয় ১৭ জন যাত্রী। সৌভাগ্যবান গানের শিক্ষক সেখান থেকে দিব্যি বেঁচে ফিরে আসেন। প্রথমবারের মতো দুর্ঘটনার শিকার হয়ে একটি হাত ভাঙা আর হাইপোথার্মিয়া ছাড়া আর তেমন কিছুই হয়নি তার। ঘটনাটি ১৯৬২ সালের।
ক্রোয়েশিয়ান এই ভাগ্যবান ব্যক্তির নাম ফ্রেন সিলাক। এই ব্যক্তি সাতবার মৃত্যুকে ফাকি দিয়ে বেঁচে ফিরেন এবং পরে ২০০৩ সালে লটারিতেও জয়লাভ করেন এক লাখ মার্কিন ডলার। তার প্রতিটি ঘটনাই যেন অবিশ্বাস্য। ১৯২৯ সালের ১৪ জুন জন্ম নেয়া ক্রোয়েশিয়ান এই নাগরিকের বয়স আর কিছুদিন পরেই ৮৯ বছর হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সাংবাদিকদের কাছে তিনি ‘ওয়ার্ল্ড’স লাকিয়েস্ট ম্যান’ এবং ‘ওয়ার্ল্ড’স লাকিয়েস্ট আনলাকিয়েস্ট ম্যান’ খেতাব জিতেছেন। সাত বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে আর চার বার ব্যর্থ বিবাহের আঘাত সহ্য করে এখনো তিনি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
পরের দুর্ঘটনাটি ঘটে ঠিক এক বছরের মাথায়। ১৯৬৩ সালে ৩২ বছর বয়সী ফ্রেনের কাছে খবর আসে তার মা অসুস্থ। য়াগরিব থেকে রিজেকাগামী বিমানে উঠে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। প্রথম ফ্লাইটে সিট না পাওয়ায় মায়ের অসুস্থতার কথা বলে বিমানবালার পাশে বসে যাওয়ার অনুমতি পান। ২০০৩ সালে টেলিগ্রাফকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, তার প্রথম বিমানযাত্রার অভিজ্ঞতা বেশ ভালোই হচ্ছিল।
বিপত্তি বাধে ল্যান্ডিংয়ের ঠিক আগমুহূর্তে। আচমকা প্লেনের দরজা খুলে যায়। তার ভাষ্যমতে, আমি আর বিমানবালা বসে চা পান করতে করতে গল্প করছিলাম। হঠাৎ করে বলা নেই, কওয়া নেই, কীভাবে যেন প্লেনের দরজা খুলে গেল। পর মুহূর্তে দেখতে পেলাম বিমানবালা বিমানের বাইরে শূন্যে ভাসছে। আর তাকে অনুসরণ করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমিও পৌঁছে গেলাম খোলা আকাশে!
কিছুক্ষণের মধ্যে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে গেল। বিমানবালা, দু’জন পাইলটসহ মোট ২০ জন যাত্রী মারা গেলেন। দৈবক্রমে সেখান থেকেও বেঁচে ফিরলেন ফ্রেন। খোলা আকাশে ভাসতে ভাসতে তিনি গিয়ে পড়েছিলেন এক খড়ের গাদার উপরে। কাজেই এত বড় একটি দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েও ছোটখাটো কিছু কাঁটা-ছেঁড়া ছাড়া বলতে গেলে কিছুই হয়নি তার! মায়ের বুকে ফিরে যান ফ্রেন।
পরের দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৬ সালে। মাইক্রোবাসে করে কোথাও যাচ্ছিলেন ফ্রেন। পথিমধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বাসটি বিকল হয়ে পার্শ্ববর্তী এক নদীর উপরে গিয়ে পড়ে। ফ্রেনের ৪ সহযাত্রীর সবাই ততক্ষণে মৃত। ফ্রেন দিব্যি সাঁতার কেটে পাড়ে উঠে আসেন। এবারও অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার পেয়েছেন তিনি।
১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সালে প্রায় একই রকম দুটি দুর্ঘটনার মুখোমুখি হন তিনি। প্রথমবার গাড়িতে আগুন ধরে গেলে তিনি একেবারে সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসেন। দ্বিতীয়বার পেট্রোল পাম্প থেকে তেল নেয়ার সময় পাম্পের বিস্ফোরণে তার গাড়িতেও আগুন লেগে গেলে মাথার বেশির ভাগ চুল পুড়ে যায় তার। ফ্রেন সিলাকের প্রাণটি এতটাই শক্ত যে, যত বড় দুর্ঘটনাই হোক না কেন, তার তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
এরপর প্রায় ২২ বছর কোনোরকম দুর্ঘটনার সম্মুখীন না হয়ে কাটিয়ে দেন ফ্রেন। ১৯৯৫ সালে য়াগরিবের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকা ফ্রেনকে সরাসরি ধাক্কা দেয় সিটি বাস। সামান্য কিছু কাঁটা-ছেঁড়া ছাড়া এবারও তেমন কিছুই হয়নি তার। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে উঁচু এক পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন ফ্রেন।
এমন সময় আকস্মিকভাবে সামনে এসে পড়া এক ট্রাকের আঘাতে গাড়ি সহ প্রায় ৩০০ ফুট গভীর খাদে পড়ে যান। অনেকটা সিনেমার মতোই গাড়ি থেকে ছিটকে এক গাছের মগডালে আটকে গিয়ে সে দফাও বহাল তবিয়তে বাড়ি ফিরে আসেন ফ্রেন। গাছের ডালে ঝুলন্ত অবস্থায় গভীর খাদে পড়ে গাড়িটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে সেবার বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন বলে জানান ফ্রেন।
অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, আস্তে আস্তে বন্ধুরা তার সঙ্গে গাড়িতে ওঠা বন্ধ করে দেয়। কেউ কেউ তো যতটা পারত, ততটা তাকে এড়িয়ে চলত। মাঝখানে কিছুদিন এমন গেছে, যেকোনো বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য পেলেই আমি খুশি হয়ে ওঠতাম। অনেকে আমাকে অপয়া বলে আমার জীবন থেকে দূরে সরে গেছে। ফ্রেনের এক প্রতিবেশির সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, আমার কানে যদি আসতো ফ্রেন কোনো ফ্লাইট বা ট্রেনের টিকেট বুক করেছে, সে সপ্তাহেই আমি আর ঘর থেকে বের হতাম না!
সে যা-ই হোক, আশাবাদী ফ্রেন নিজের মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার ঘটনাগুলো থেকে ফিরে আসার ব্যাপারটিকে শুভ বলেই ধরে নিতেন। তার মতে, প্রতিটি মুদ্রার দু’পিঠ থাকে। হয় আমি পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা ব্যক্তি, নয়তো সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি। নিজেকে দ্বিতীয়টি ভাবতেই বেশি পছন্দ করি আমি। মৃত্যুর সঙ্গে শেষবার পাঞ্জা লড়ার সপ্তাহখানিকের মধ্যে খবর আসে ফ্রেন লটারিতে এক লাখ মার্কিন ডলার জিতেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না আমার সাথে।
লটারি জেতার পর শুরুতে তার শপিং লিস্টে ছিল একটি নতুন বাড়ি, একটি গাড়ি আর স্পিডবোট। তবে পরমুহূর্তেই বুঝতে পেরেছেন, এত পরীক্ষার পর আজ এই শেষ বয়সে যে তাকে এতটা সৌভাগ্যের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছেন, তাকে ধন্যবাদ না জানালে নিজের কাছেই অপরাধী হয়ে থাকবেন। কাজেই নিজের জন্মভূমি পেট্রিঞ্জায় একটি চ্যাপেল নির্মাণ করার উদ্যোগ নেন তিনি। এখন তার ডাকনাম হয়ে গেছে ‘মিস্টার লাকি’!