পেঁয়াজপুরাণ
রান্নার জনপ্রিয় আনাজ পেঁয়াজ যেন এখন মহার্ঘ। চড়া দামের কারনে হঠাত্ ঊঠে এসেছে আলোচনার পাদপ্রদীপে। পেঁয়াজ নিয়ে লেখা হচ্ছে প্যারোডি, গান, ছড়া ও রম্য। এমনকি বিয়ে বাড়িতেও হেঁশেলের এই পণ্যটি উপহাস করে ‘উপহার’ হিসাবে দিচ্ছেন অনেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুসারে, পৃথিবীতে যখন কৃষি কাজের প্রচলন হয়নি সেই সময়েও খাদ্য হিসেবে পেঁয়াজ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাগৈতিহাসিক লোকেরা কৃষিকাজ উদ্ভাবনের অনেক আগে থেকেই বুনো পেঁয়াজ খেতেন। প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করতো মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য পেঁয়াজ অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাদের সমাধির মধ্যে তারা পেঁয়াজ রাখতো। এই ঘটনার সবচেয়ে চমকপ্রদ প্রমাণ পাওয়া যায় রাজা চতুর্থ রামেসিসের সমাধিতে।
সেটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর দেখা যায়, রাজা চতুর্থ রামেসিসের মমির দুই চক্ষু কোটরে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে পেঁয়াজ! এছাড়াও মৃতদেহের শরীরের নানা অংশে পেঁয়াজ রাখা হতো। বুকে পেঁয়াজের ফুল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। মমির কান, পায়ের পাতা ইত্যাদি প্রত্যঙ্গ পেঁয়াজ দিয়ে সাজানো হতো। বহু মিশরীয় পিরামিডের ভিতরের নানা চিত্রকর্মেও পেঁয়াজের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। মিশরীয়রা পেঁয়াজকে জাদুকরী বস্তু মনে করতো।
তবে প্রাচীন মিশরীয়দের তুলনায় প্রাচীন গ্রিকরা পেঁয়াজের ব্যবহারে ছিল কয়েক ধাপ এগিয়ে। তারা পেঁয়াজের বহু স্বাস্থ্যগত উপকারিতা সম্পর্কে অবগত ছিল। ফলে প্রাচীন গ্রিসের ক্রীড়াবিদরা প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ খেতো। এছাড়াও নিজেদের পেশী আরো মজবুত ও শক্তিশালী করতে রোমান গ্লাডিয়েটররা তাদের শরীরে পেঁয়াজ মালিশ করতো। রোমানরাও পেঁয়াজের নানা উপকারী দিক সম্পর্কে জানতো। তারা দাঁতের ব্যথা কিংবা অনিদ্রা দূর করতে পেঁয়াজ খেতো। প্রাচীন রোমে যে ব্যাপক আকারে পেঁয়াজের চাষ হতো তার প্রমাণ পাওয়া যায় অগ্নুত্পাতে চাপা পড়ে যাওয়া পম্পেই নগরীতে। সেখানেও প্রত্নতত্মবিদরা পেঁয়াজ চাষের প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন।
বাইবেলেও ইসরাইলিদের পেঁয়াজ খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে পেঁয়াজকে দেখা হতো ‘সুপার-ফুড’ হিসাবে। সেসময় মানুষ মুদ্রার মতো পেঁয়াজ ব্যবহার করতো। নানা কাজের পারিশ্রমিক হিসাবে কিংবা ভাড়া পরিশোধ করার ক্ষেত্রেও পেঁয়াজের প্রচলন ছিল। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান যেমন বিয়েতে মানুষ বর-কনেকে পেঁয়াজ উপহার দিতো।
মধ্যযুগে ইউরোপীয় রান্নার প্রধান তিন উপাদান ছিল শিম, পেঁয়াজ ও বাঁধাকপি। ধনী গরীব নির্বিশেষে সবাই খাবারে পেঁয়াজ ব্যবহার করতো। কয়েকজন রোমান ঐতিহাসিক লিখেছেন মধ্যযুগে রোমান সাম্রাজ্যে পেঁয়াজের বহুমুখী ব্যবহারের কথা। মাথাধরা, সাপের কামড় ও মাথার চুল গজানোর ওষুধ হিসেবে এর ব্যবহার ছিল। ইতালীয় ইতিহাসবিদ প্লিনি দ্য এলডার লিখেছেন, শক্তি বাড়াতে, মুখের ঘা শুকাতে, দাঁতের ব্যথা উপশমে কিংবা কুকুরের কামড়ের প্রতিষেধক হিসেবে পেঁয়াজ ব্যবহূত হতো। আর এ রোমানদের হাত ধরেই পেঁয়াজ ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপজুড়ে। শাসনের উদ্দেশ্যে যখন তারা স্পেন, ফ্রান্স, ব্রিটানিয়া, রোমানিয়া কিংবা জার্মানি যেখানেই গেছে, সঙ্গে করে নিয়ে যেত পেঁয়াজ। রোমানদের মধ্যে পেঁয়াজপ্রেমী সম্রাট নিরো শরীর ঠান্ডা রাখতে প্রায়ই পেঁয়াজের রস সারা শরীরে মেখে শুয়ে থাকতেন।
মিশরের রাজা চতুর্থ রামেসিস মৃত্যুবরণ করেছিলেন ১১৬০ খ্রিস্টপূর্বে। তিনিও পেঁয়াজের নেকলেস পরতেন। উনিশ শতকে যখন তার সমাধিস্থল আবিষ্কৃত হয় তখন দেখা যায় কবর দেয়ার সময় পেঁয়াজ দিয়ে নেকলেস বানিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল তার গলায়। তার চোখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশে গাথা আছে পেঁয়াজ। গ্রিকদের পেঁয়াজপ্রীতি বহু গুণ বেড়ে যেত অলিম্পিকের সময়। প্রতিযোগীরা প্রচুর পেঁয়াজ খেত, লিটার লিটার পেঁয়াজের রস গলায় ঢালত, সারা শরীরেও তা মাখত। তাদের ধারণা ছিল, পেঁয়াজ শরীরের গাঁট শক্তপোক্ত করে আর ব্যথা-বেদনা তাড়ায়।
পূর্ব ইউরোপে প্লেগ মহামারীর সময় মানুষ ঘরের জানালায় পেঁয়াজ ঝুলিয়ে রাখতো। তারা বিশ্বাস করতো এতে করে অশুভ আত্মা দূরে চলে যায়। ইউরোপের মানুষ কথিত ভ্যাম্পায়ারদের কবল থেকে রক্ষা পেতে ঘরের দরজা, জানালা ও গলায় পেয়াজ-রসুনের মালা ঝুলিয়ে রাখতো।
ভারতবর্ষের চিত্রটি ছিল একেবারে উল্টো। বেদ, উপনিষদ কোথাও পেঁয়াজের উল্লেখ নেই। কারণ পেঁয়াজ ছিল ‘যবন ও ম্লেচ্ছদের খাবার’। লোকে বিশ্বাস করত পেঁয়াজ আর রসুনে জৈবিক উত্তেজনা বাড়ে। সে জন্য ছাত্র ও বিধবাদের কাছে তো একেবারে নিষিদ্ধ ছিল এই সবজি। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৬০০ অব্দে চরক সংহিতা ভেষজ ওষুধ হিসেবে প্রথম পেঁয়াজের গুণকীর্তন করেন। চরক তার আয়ুর্বেদ বইয়ে পেঁয়াজের গুণের কথা লেখেন। তবুও সে সময়ে ভারতবর্ষে পেঁয়াজ ততটা জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। আর সেটার পরিচয় পাওয়া যায় চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েনের ভ্রমণ বৃত্তান্তে। তিনি তার ভারত ভ্রমণের সময় সারা দেশে কোথাও পেঁয়াজের ব্যবহার দেখেনি।
ভারতে পেঁয়াজ জাতে উঠেছিল মোগল ও সুলতানি আমলে। বিশেষ করে মুসলমানদের হাত ধরে। ইবনে বতুতার লেখায় আছে, তেরো শতকে দিল্লির সুলতানের দরবারে ভাজা পেঁয়াজের পুর দেয়া সমুচা খুব জনপ্রিয় ছিল। আর ‘আইন-ই আকবরি’তে লেখা সব পদেই পেঁয়াজের ছড়াছড়ি। এখান থেকেই ধাপে ধাপে পেঁয়াজ এ দেশের সাধারণ মানুষের হেঁশেলে ঢুকে পড়ল। দিল্লির সুলতানদের রাজকবি আমির খসরু লিখেছেন, ১৩০০ সালের দিকে মাংস, ঘি আর পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি সমুচা রাজকুমাররা ও তাদের পর্ষদগণ ভীষণ উপভোগ করে খেতেন!
ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন ইতিহাসের গোড়ার দিকে চাষ হওয়া কিছু ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। সহজেই নানা জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া, ধীর পচনশীলতা ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় প্রাচীন মানুষের কাছে পেঁয়াজ ছিল অতি প্রয়োজনীয় একটি খাদ্যপণ্য। আমেরিকান পেঁয়াজ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, পানির মতো প্রাচীন মানুষের তৃষ্ণাও নাকি মেটাতো এই পেঁয়াজ!
ষোড়শ শতাব্দীতে মানুষ যখন আটলান্টিকের অন্য পাশের উন্নত জীবন ও জীবিকার আশায় পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধে পাড়ি জমালো, তখন তারা তাদের সঙ্গে করে কিছু পেঁয়াজ নিয়ে আসতে ভোলেনি। তাদের ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে জানা যায়, আমেরিকায় সেই ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমেই প্রথম পেঁয়াজের চাষ শুরু হয়। উত্তর আমেরিকায় পাড়ি জমানো প্রথম ঔপনিবেশিকদের প্রথম চাষ করা ফসল ছিল পেঁয়াজ। তবে, ইউরোপীয়দের আগমনের আগেই আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে পেঁয়াজের ব্যবহার চালু ছিল। তারা নানা সিরাপ, রঙ ও ওষুধ প্রস্তুত করার জন্য পেঁয়াজ ব্যবহার করতো। প্রাচীনকালের বিভিন্ন গ্রন্থে পেঁয়াজকে মূত্রবর্ধক, হজমে সহায়ক, হূদপিন্ড ও চোখের জন্য উপকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এসব বর্ণনার সত্যতা মিলছে বর্তমানের আধুনিক নানা গবেষণাতেও।
সূত্র:ইত্তেফাক