চায়ের সাতকাহন
চা নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন এক চীনা কবি। চীনের তাং কবি লোটাং লিখেছেন, ‘প্রথম কাপ আমার ঠোঁট ও গলা ভেজায়, দ্বিতীয় কাপ আমার একাকিত্ব দূর করে, তৃতীয় কাপ নীরস অস্ত্রের খোঁজ করে এবং দেখে যে সেখানে অদ্ভুত ভাবনির্দেশক ৫ হাজার গ্রন্থ, চতুর্থ কাপ আমাকে ঘর্মাক্ত করে আর তাতে শরীরের সব দূষিত বস্তু লোমকূপ দিয়ে বেরিয়ে আসে, পঞ্চম কাপে আমি পবিত্র হই, ষষ্ঠ কাপ আমাকে অমরত্বে নিয়ে যায়। সপ্তম কাপ-আহা, কিন্তু আমি আর পারি না, আমি শুধু ঠান্ডা বাতাসের শ্বাস অনুভব করি যা আমার জামার ভেতর দিয়ে উঠে আসে। হোরাইসা কোথায়? আমাকে মধুর সমীরণের ওপর চড়তে দাও আর হাওয়া ও পানির ওপর দিয়ে ভাসতে।’
এখন এই আধুনিক বিশ্বে শত রকমের চা। তার খোঁজ রাখাটাও বেশ কষ্টের। নানা স্বাদের নানা গন্ধের চা। কোন চায়ের কেমন গন্ধ, কোন এলাকার চায়ের লিকার গাঢ়, কোন চায়ের দুটি পাতা ভিজিয়ে সারা দিন খাওয়া যায়। গ্রিন টি এসে তো বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে এত শত রকমের চা আছে তা সাধারণ ক্রেতাদের অগোচরেই রয়ে গেছে।
চা বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়। চায়ের কচি পাতার নির্যাস সারা বিশ্বের মানুষকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে রেখেছে। চা-কে বলা হয় নিষ্পাপ পানীয়, নিরাপদ পানীয় যার কোনো ক্ষতিকর দিক নেই, নেই মাদকতা। বরং আশ্চর্য এই পানীয় মানুষের মাঝে সজীবতা ছড়িয়ে দেয়। বিশ্ব জুড়ে এই চা নিয়ে যে কত্ত কত্ত তোড়জোড় চলছে। বিজ্ঞানীরা ব্যস্ত নানা জাতের উদ্ভাবনে, কোন এলাকার গাছের কেমন গন্ধ তা নিয়ে রীতিমত গবেষণা চলছে। সেই পানীয় না খেলে কারো সকালে ঘুমের চটকা ভাঙে না, কারো সারা দিন মাথা ঝিম ঝিম করে। কারো কাছে শরীর-মন সতেজ রাখার নাম চা। এখন তো চা সৌন্দর্য চর্চা, রূপ লাবণ্য ধরে রাখার জন্যেও নিয়মিত পান করছেন স্বাস্থ্য সচেতনরা।
চায়ের আবিষ্কার চীনে। এই নামটিও এসেছে চীনের উপজাতিদের ‘অময়’ ভাষার শব্দ ‘তে’ (te) থেকে পরে ক্যান্টনিজ ভাষায় চা (cha) শব্দটির উত্পত্তি। চা শব্দটি পারস্য, পর্তুগিজ, জাপান, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ভাষায় মিশে গেছে। আমাদের উপমহাদেশেও ফরাসি ও অন্য শব্দের সঙ্গে চা শব্দটি বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে।
হরেক রকম চা
দুধ চা, লিকার চায়ের কথা কম-বেশি আমরা সবাই জানি। গ্রিন টি এখন শহুরে মানুষের পছন্দের শীর্ষে। বিশ্বের নানা স্বাদের, গন্ধের চা সংগ্রহ করার শখ আছে অনেকেরই। এখন বাজারে এসেছে ‘হোয়াইট টি’। এ আবার কেমন চা রে বাবা। বাংলাদেশ টি বোর্ড উদ্ভাবন করেছে এই হোয়াইট টি যার ২৫ গ্রামের দাম ৪০০ টাকা। এই চায়ের দুটি পাতাই একজন মানুষের সারা দিনের চায়ের চাহিদা মেটাবে। শুধু বারবার গরম পানি ঢালতে হবে সেই চায়ে।
চা প্রধানত চার রকমের। চাইনিজ, আসাম, মণিপুরি ও বার্মা। এছাড়া হাইব্রিড, ক্লোন চা রয়েছে। বাংলাদেশে যেসব চা উত্পাদন করা হয় তা আমাদের এই আবহাওয়ায় যাতে ভালো ফলন দেয় সেভাবে উন্নয়ন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাঁচটি বীজের উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। এছাড়া ২০টি চায়ের ক্লোন প্রস্তুত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সিলেটের মৌলভীবাজারে অবস্থিত গবেষণা কেন্দ্রে ৫৭৬টি চায়ের জার্ম প্লাজম ব্যাংক সংরক্ষণ করা হয়েছে। চা বিশেষজ্ঞরা জানান, সমৃদ্রপৃষ্ঠ থেকে যত উঁচুতে যাওয়া যাবে চায়ের ঘ্রাণ তত বাড়তে থাকে। তবে সব জায়গায় ইচ্ছা করলেই চা উত্পাদন সম্ভব নয়।
চায়ের আবিষ্কার
ধারণা করা হয়, চীনা দার্শনিক কনফুশিয়াসের সময় অথবা খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০ শতাব্দীতে ব্যবহার শুরু হয় চায়ের। ৭৯৩ সালে চীনে চায়ের ওপর কর ধার্য করা হয়েছিল। ৯ম শতাব্দীতে চীন থেকে চা জাপানে পৌঁছলেও জাপানিরা ১২০৬ সালে এর চাষ শুরু করেন। চীনারা দাবি করেন যে খ্রিষ্টপূর্ব ৫ হাজার বছর আগে সম্রাট শেন নাং ঘটনাচক্রে চায়ের আবিষ্কার করেন। ‘দি হারবাল ক্যানন অব শেন নাং’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয় যে, চায়ের নির্যাসে ৭২ রকমের বিষকে নির্বিষ করার ক্ষমতা রয়েছে। এদিকে, বর্তমান সময়ে এসে চীনের ইউনান প্রদেশে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে প্রমাণ মিলেছে মৃত মানুষের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে চা ছিল প্রয়োজনীয় উপাদান। এমনকি কবরের ভেতরে চায়ের ডাল পাতা দেওয়া হতো। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর পরে চা ইউনান থেকে অন্য প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় রাজদরবারে মদ্যপানের বদলে চা পানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
চীনের বাইরে চা এলো যেভাবে
১৬০০ শতাব্দীতে চা ডাচদের মাধ্যমে ইউরোপে যায়। ১৭০০ শতাব্দীতে চা ইংল্যান্ডে পৌঁছায়। লন্ডনে ১৬৫৯ সালে প্রথম চায়ের দোকান হয়। ১৬৬৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখনকার ব্রিটিশ সম্রাট দ্বিতীয় চার্লসকে ২ পাউন্ড ২ আউন্স চা উপহার দেন। সেকালে ঐ চায়ের দাম ছিল প্রতি পাউন্ড ৪০ শিলিং। ১৬৭৭ সালে কোম্পানি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চীন থেকে চা রপ্তানি করতে থাকে। তখন চায়ের জন্য পুরোপুরি চীনের ওপরেই নির্ভরশীল ছিল সারাবিশ্ব। চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে বিকল্প হিসাবে ১৭৮০ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চায়ের গাছ তৈরি হয় কিড সাহেবের নিজের বাগানে। সেই বাগান এখন কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেন নামে পরিচিত। কিড সাহেব কোম্পানিকে জানিয়ে দেন যে, শিবপুর চায়ের জন্য উপযুক্ত জায়গা নয়। তারপর ১৮১৯-১৮৩৪ সালের মধ্যে আসাম ও মণিপুরে চা-গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। রবার্ট ব্রুস ১৮৩৪ সালে আসামের উঁচু অঞ্চলে চা-গাছের সন্ধান পান, যা ভারতে চা-শিল্পের ভিত্তি স্থাপন করে। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দুধ ও চিনিসহ বিনা মূল্যে চা খাইয়ে একে জনপ্রিয় করে তোলে।
বাংলাদেশে চা
চায়ের কারণেই আমাদের সিলেট বিখ্যাত। সিলেট অঞ্চলকে বলা হয় দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে ‘স্ক্যানস পাইওনিয়ার টি স্টেট’ বাগানটি তৈরি হয় বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব ও বাঘঘোনা-লালখান বাজার এলাকার টিলা অঞ্চলে। সিলেটের মালনিছড়া চা-বাগান হয় ১৮৫৪ সালে। কাজেই প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মালনিছড়া নয় চট্টগ্রামেই প্রথম চা উত্পন্ন হয়। কিন্তু চট্টগ্রামের চা-বাগানটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আরো একটি তথ্যে জানা যায়, ১৮২৮ সালে চট্টগ্রামের কোদালা চা-বাগানের জন্য জমি লিজ নেওয়া হয়।
সেই সময় থেকে এখন দেশে চা-বাগানের সংখ্যা ১৭৪টি। এগুলো হলো—মৌলভীবাজারে ৯১টি, হবিগঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রামে ২২টি, সিলেটে ২০টি, পঞ্চগড়ে পাঁচটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি, রাঙ্গামাটিতে একটি ও ঠাকুরগাঁওয়ে একটি চা-বাগান গড়ে ওঠে। চলতি বছর বাংলাদেশে চায়ের উত্পাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৯০ মিলিয়ন কেজিতে উন্নীত হওয়া সম্ভব, যা দেশের চা উত্পাদনে ১৬৫ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড। দেশের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে প্রতি বছর চা আমদানি করা হয়। তবে বাংলাদেশের ভালো মানের চা খুব অল্প পরিমাণে হলেও রপ্তানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে চা-শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক।
দুটি পাতা একটি কুঁড়ি
গাছ থেকে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি সংগ্রহ করা হয়। সব ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয় না। অবস্থা ভেদে ভিন্ন ব্যবস্থা হয়। আবার এর বাড়তি পাতা বাদ দিতে চাইলে মেশিনে ব্যবস্থা আছে। একবার তোলার পর ৮-১০ দিনে গাছে নতুন পাতা গজায়। শীতে চা পাতা তোলা কমে যায়। প্রাক গ্রীষ্মে আবার শুরু হয়। গ্রীষ্ম ও বর্ষা হলো এর ভরা মৌসুম। পাতা তোলার কাজ প্রায় সব দেশে মেয়েরা সুনিপুণভাবে করেন। পিঠে ঝুড়ি বাঁধা, মাথার পাগড়িতে দড়ি দিয়ে ঝুড়ি ঝুলিয়ে চা-পাতা ছিঁড়ে পেছনের ঝুড়িতে রাখার ছবি সবাই দেখেছেন।
বাংলাদেশের চা-বাগানগুলোর মালিকানা প্রধানত তিন ধরনের। স্টারলিং কোম্পানি, বাংলাদেশি কোম্পানি এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন। যে সব চা-বাগানের মালিক বিদেশি, বিশেষত ব্রিটিশ, তাদেরই বলা হয় স্টারলিং কোম্পানি। দেশীয় যে সব প্রতিষ্ঠান কোম্পানি অ্যাক্ট দ্বারা গঠিত, সেগুলো বাংলাদেশি কোম্পানি। স্টারলিং কোম্পানির চা-বাগানগুলো আয়তন ও চা উত্পাদনের দিক থেকে বৃহত্তম। এরপর রয়েছে বাংলাদেশি কোম্পানির মালিকানাধীন বাগান এবং সবচে ছোটো বাগানগুলো মূলত ব্যক্তি মালিকানাধীন।
বাংলাদেশীয় চা সংসদের সিলেট বিভাগের চেয়ারম্যান জি এম শিবলী জানান, চায়ের উত্পাদন বাড়াতে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বনে গত তিন বছরে দেশে গড়ে ১২ মিলিয়ন কেজি করে চা উত্পাদিত হয়েছে। বাগানমালিকরা এখন পুরাতন চা-গাছ তুলে নতুন চারা রোপণ করছেন। একইভাবে নতুন করে বাগানের পরিধিও বাড়ানো হচ্ছে, যে কারণে চায়ের উত্পাদন বাড়ছে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক ড. কে এম রফিকুল হক জানান, শুধু উত্পাদন বৃদ্ধি নয়, এ বছর চায়ের গুণগত মানও ভালো হয়েছে। উত্পাদনের ধারা অব্যাহত থাকলে এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা ৯০ মিলিয়ন কেজি ছাড়িয়ে যাবে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে রপ্তানিও করা যাবে বলে আশা করছেন তিনি।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম জানান, দেশের চায়ের উত্পাদন ও গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) এ পর্যন্ত ২১টি উচ্চ ফলনশীল ক্লোন অবমুক্ত করেছে। জাতীয় গড় ফলন বৃদ্ধির জন্য চা-বাগানসমূহে বিটিআরআইয়ের উদ্ভাবিত উন্নত জাতের ক্লোন এবং প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। উত্পাদন, নিজস্ব স্বাদ, বৈচিত্র্য, ব্র্যান্ডিং এবং এ দেশের চা আজ বহুগুণে এগিয়ে আছে।