জেলা থানা কমিটিতেও বহু অনুপ্রবেশকারী
মতাসীন আওয়ামী লীগের শুধু ঢাকা মহানগর কমিটিতেই নয়; জেলা, উপজেলা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়নসহ তৃণমূলের প্রতিটি কমিটিতেই রয়েছেন অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিতরা। শুধু তা-ই নয়, দলের অঙ্গ-সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর কেন্দ্র থেকে শুরু করে সকল স্তরের কমিটিতেও বিএনপি, জামায়াত ও ফ্রিডম পার্টিসহ বিভিন্ন দল থেকে ঝাঁকে-ঝাঁকে ঢুকেছেন অনেকে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগসহ এর অঙ্গ-সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর কমিটিও অনুপ্রবেশকারীতে ভরা। দল টানা প্রায় ১১ বছর ক্ষমতায় থাকায় তুলনামূলক বেশি সুযোগ-সুবিধাভোগীও এই অনুপ্রবেশকারীরাই। তাদের বিত্ত-বৈভব আর প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা প্রকৃত নেতাকর্মীরা।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল বৃহস্পতিবার বলেছেন, জাতীয় সম্মেলন সামনে রেখে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। জেলা থেকে শুরু করে প্রতিটি সম্মেলনে এ তালিকা ধরে অনুপ্রবেশকারীদের দল থেকে বাদ দেওয়া হবে।
তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা মহানগরের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা কমিটিতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সন্তান-নাতিরাও ঢুকে পড়েছে। যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ স্থানীয় নেতার হাতে সোনার তৈরি নৌকা তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বাগিয়ে নিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ দলীয় পদ। পরবর্তী সময়ে দলীয় পদ ব্যবহার করে টেন্ডার, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রকেট গতিতে বনে গেছেন কথিত ‘বড়ো নেতা’ ও অঢেল অর্থ-বিত্তের মালিক। অর্থ আর দলীয় পদের প্রভাবে কোথাও কোথাও স্থানীয় প্রশাসনও তাদের হাতের মুঠোয়।
অভিযোগ রয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টাকার বিনিময়ে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন দল থেকে অনেকে আওয়ামী লীগে ঢুকে পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের ও দলীয় সংসদ সদস্যদেরও কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে অন্য দলের লোকজনকে দলে যোগদান করিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে নিজের পৃথক বলয় তৈরি করেছেন—যার প্রতিফলন দেখা গেছে উপজেলা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ওয়ার্ডসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে। নিজস্ব বলয়ের মাধ্যমে প্রভাব-প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখতে এসব নেতা-এমপিরা দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে নিজস্ব প্রার্থী দিয়েছেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে এসব নেতা-এমপিকে শনাক্ত করে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়ারও উদ্যোগ নেয়।
এ ব্যাপারে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনে বিতর্কিতদের যাতে অনুপ্রবেশ না ঘটে, সেজন্য আমরা সতর্ক আছি। নিজস্ব কিছু লোকজন ও গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের একটি তালিকা তৈরি করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ইতিমধ্যে দলীয় কার্যালয়ে তালিকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। শাখা ও সহযোগী সংগঠনের সম্মেলনের ক্ষেত্রে তালিকা দেখেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যাতে তালিকায় যাদের নাম আছে তারা আবারও অনুপ্রবেশ করতে না পারে।’
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১১ বছরে একাধিক সময়ে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ অভিযানের সময় অনেক বিতর্কিত লোকজন দলে প্রবেশ করেছে। সর্বশেষ এ বছরের ১ জুলাই থেকে সারাদেশে প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রমেও অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে পারিবারিক পরিচয় ও নতুন সদস্যদের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই না করায় এই ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের এই নেতারা।
অনুপ্রবেশকারীর উদাহরণ দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ইত্তেফাককে জানান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কদমতলী থানা শাখায় অনুপ্রবেশকারীদের সম্পর্কে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন যায় দলের কেন্দ্রে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও এ ব্যাপারে প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে থানা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রাসেল ইকবালের বিষয়ে বলা হয়েছে, তার বাবা নুরুল ইসলাম বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি সালাউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সালাউদ্দিন ও আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত স্থানীয় নেতা লুত্ফর রহমানের (সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান) বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন এই নুরুল ইসলাম। তার ছেলে রাসেল ইকবাল একসময় বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাসাসের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই রাসেল ইকবাল এখন আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে বিত্ত-বৈভবের মালিক। যদিও রাসেল ইকবাল দাবি করেছেন, এসব অভিযোগ অসত্য, তিনি ছাত্রলীগ-যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। একইভাবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তর আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার বিষয়েও তথ্য গেছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কার্যক্রম, ক্যাসিনো-মাদক ব্যবসা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িতদের বেশির ভাগই দলে অনুপ্রবেশকারী। যার কারণে এদের বিরুদ্ধে গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অভিযান শুরু হয়। অভিযানে এখন পর্যন্ত গ্রেফতারকৃতদের প্রায় সবাই যুবলীগ-আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী বলে অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী লীগে প্রবেশের আগে তারা বিভিন্ন সময় অন্য দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসব দল এবং অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পদে ছিলেন তারা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ধীরে-ধীরে তাদের অবস্থান পালটাতে থাকে। ঢাকায় ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিতরা এসেছেন ফ্রিডম পার্টি, বিএনপি ও এরশাদের জাতীয় পার্টি (জাপা) থেকে। এদের হাত ধরেই প্রথমে মতিঝিলের ক্লাবপাড়া, পরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ক্যাসিনোর প্রসার ঘটে।