ঘুমন্ত মানুষের বিছানায় উঠে দংশন করে এই সাপ
বাংলাদেশে বছরে কত জন সাপের দংশনে মারা যান তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রতিদিন এতে একাধিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে নিঃসন্দেহে।
গত সপ্তাহে কালাচ সাপের কামড়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে মারা গেছেন নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার রামচরণপুর গ্রামের নূর ইসলাম (৩০) ও তার স্ত্রী মৌসুমি খাতুন (২৬)। এর আগের রাতে নিজ শোবার ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন নূর ও মৌসুমি। রাত ২টার দিকে মশারি ভেদ করে বিছানায় উঠে সাপটি দুজনকেই দংশন করে। টের পেয়ে স্বজনরা বিছানা থেকে সাপটিকে জাল দিয়ে আটক করে ফেলেন। হাসপাতালে নেয়ার পর সাপটি শনাক্ত করেন চিকিৎসক। বাংলাদেশে যে কয়টি বিষধর সাপ আছে তার মধ্যে কালাচ বা কেউটে ভয়ংকর বিষধর একটি সাপ। যে সাপটি নীরবে কামড় দিয়ে চলে যায়। এর কামড়ে শতভাগ বিষ প্রয়োগ হয়। তাই সময় মতো চিকিৎসা না করাতে পারলে মৃত্যু নিশ্চিত। অন্যান্য সাপ কামড় দিলে মানুষ বুঝতে পারে কিন্তু কেউটের কামড়ে অনেকটা মশার মতো ব্যথা হয়। ফলে অনেক সময় মানুষ বুঝতে পারে না সাপে কামড় দিয়েছে। এমনকি জ্বালা-যন্ত্রণাও হয় না, আক্রান্ত জায়গা ফোলেও না। এতে ৯০ শতাংশ রোগী বুঝতেই পারে না তাকে সাপে দংশন করেছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশ কয়েক ঘণ্টা পর রোগীর তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়ে বা ঘুমে থাকলে ভোরে ব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে ওঠেন। রোগীর চোখের পাতা পড়ে আসে, বমি বমি ভাব হয়, জ্বর হলে যেমন অস্বস্তি হয় তেমনটা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রক্ত জমাট বাঁধা শুরু করে তাই এ অবস্থায় রোগীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিতে হবে দ্রুত। সেখানে নিয়ে অ্যান্টি স্নেক ভেনাম (এভিএস) প্রয়োগে চিকিৎসা না দেয়া হলে রোগী ধীরে ধীরে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবে।
এ বিষাক্ত সাপ গুপ্তঘাতক বিষাক্ত কেউটে বা কালাচ। এ সাপ দংশন করলে বিষ প্রয়োগ হবেই। এটি একটি ফনাহীন সাপ। বাংলাদেশে এই কেউটে সাপ কালাচ নামেও পরিচিত। এদের ইংরেজি নাম Common Krait বৈজ্ঞানিক নাম Bungarus caeruleus। ঘুমন্ত মানুষকে দংশন করে বলে এই সাপকে ‘ঘামচাটা’ সাপও বলা হয়।
বাংলাদেশে শতাধিক প্রজাপতির সাপের দেখা মেলে। এই সাপের বেশির ভাগই বিষমুক্ত। যেগুলোর দংশনে মানুষের মৃত্যু হয় না। তবে কিছু সাপ আছে যাদের দংশনে মৃত্যু হতে পারে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ৩ প্রজাতির গোখরা, ২ প্রজাতির ঢোড়া, ৪ প্রজাতির বোরা, ৩/৪ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ ও ২/১ প্রজাতির কোরাল সাপ এবং পাতি কেউটেসহ ৪ প্রজাতির কেউটে আছে যা বিষধর।
কালাচ বা কেউটে সাপকে নিয়ে প্রচলিত আছে যে এই সাপ ঘুমন্ত মানুষের বিছানায় উঠে আসে ঘামের গন্ধ নিতে। তবে এর পক্ষে বিপক্ষে অনেক মতবাদ থাকলেও বৈজ্ঞানিক ভাবে সাপের ঘ্রাণ শক্তি আছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কালাচের প্রজনন মৌসুম মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত।
বাংলাদেশের সব সবজায়গাতেই এই সাপ আছে কিন্তু মানুষের চোখে পড়ে না। কারণ এরা নিশাচর। গভীর রাতে এরা বিচরণ করে। এরা খাড়াভাবে উপরে উঠতে পারে। উপরে উঠে মানুষের বিছানায় গিয়ে অবস্থান করে বলেই একে ঘামচাটা সাপ বলা হয়।
এরা খাড়াভাবে উপরে উঠে মানুষের বিছানায় চলে যায়, ঘুমন্ত অবস্থায় পাশ ফেরার কারণে শরীরের নিচে চাপা পড়ে অথবা হাত পা নড়াচড়া করলে নীরবে দংশন করে দ্রুত কেটে পড়ে এ সাপ। এই সাপের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে এরা শতভাগ বিষ প্রয়োগ করে। অন্যান্য বিষাক্ত সাপ দংশন করলে তার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ থাকে ড্রাইবাইট। ড্রাইবাইট হচ্ছে দংশন করবে ঠিকই কিন্তু বিষ প্রয়োগ করবে না। তবে কালাচের দংশনে কোনো ড্রাইবাইট নেই। সে দংশন করা মানেই বিষ প্রয়োগ হবে। যেহেতু এই সাপ দংশন করলে মানুষ সেটা বুঝতেই পারে না এটা মৃত্যুর বড় কারণ। সাপটির দাঁত মশার হুলের মতো। তাই এর দংশনে বেশিরভাগ সময় দাগ পড়ে না।
বাংলাদেশ স্নেক অ্যান্টিভেনম প্রজেক্টের সহকারী গবেষক বোরহান বিশ্বাস রোমন জানান, ক্রেইট গোত্রের সব সাপ বিষাক্ত। ক্রেইট গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এই সাপের কামড়ে মানুষ মারা যায়, শুধু বাংলাদেশ নয় ভারত, পাকিস্তান, চায়না, নেপালে এই সাপের কামড়ে প্রচুর মানুষ মারা যায়।
‘এদের কামড়ের পর জ্বলা বা ব্যাথা হয় না তাই ভিকটিম বুঝে উঠতে পারে না যে সাপে কামড় দিয়েছে। এই সাপ ঘরে গিয়ে যেমন মানুষকে কামড় দেয় তেমনি জেলেরাও আক্রান্ত হয়। কারণ এরা জলাশয়ের আশপাশেও থাকে। তবে অন্যান্য সাপের চেয়ে এই সাপের কামড়ে বিষের প্রতিক্রিয়া দেরিতে শুরু হয়।’
তিনি বলেন, এ সাপ থেকে বাঁচতে হলে রাতের বেলায় মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। টর্চ ছাড়া বাইরে বের হওয়া ঠিক হবে না এবং যারা মাছ শিকার করে তারা যেনো আশপাশের অবস্থা খেয়াল রাখে। বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখতে হবে।
তিনি আরো জানান, এ সাপে কামড় দেয়ার ৭২ ঘণ্টা পরেও রোগীর মৃত্যুর রেকর্ড আছে। এটি দংশন করলে যত দ্রুত সম্ভব মেডিকেল কলেজে যেতে হবে। কারণ মেডিকেল কলেজে সাপের কামড়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে যা উপজেলা বা অনেক জেলা হাসপাতালে নেই।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. মনোয়ার হাসান জানান, কালাচ একটি গুপ্তঘাতক সাপ। এই সাপের বিষে প্যারালাইসিস হতে শুরু করে। এর একটি দংশনে ২০ মি.লি. বিষ শরীরে প্রবেশ করে। এর বিষ নিউরোটক্সিন। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে মৃত্যু নিশ্চিত।
তিনি বলেন, যদি অন্যান্য সাপের দংশনের ৪৮ ঘণ্টা পরও কোনো সমস্যা না হয় বুঝতে হবে রোগী আশঙ্কামুক্ত। তবে এই হিসাব কেউটে বা কালাচ সাপের বেলায় মিলবে না। কারণ এই সাপের দংশনে বিষক্রিয়া হবেই।