ক্যাসিনো সেলিম প্রধানের পাঁচ বউ; ১২ পাসপোর্ট
অনলাইনে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার মূলহোতা সেলিম প্রধানকে আটকের পর বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, সেলিম প্রধানের মোট পাঁচজন বউ আছে। শুধু তাই-ই নয় তার ১২টি পাসপোর্টও আছে।
জানা গেছে, সেলিমের বউদের মধ্যে একজন রাশিয়ান, একজন আমেরিকান, একজন জাপানিজ এবং দু’জন বাংলাদেশি। সেলিমের ছোট বউ বা ৫ নম্বর বউ সহকারী কাস্টমস কমিশনার। বর্তমানে কর্মরত আছেন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে।
সূত্রমতে, সেলিম প্রধান কারাবন্দি বিএনপি শাসনামলের আলোচিত দুর্নীতিবাজ গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের বিজনেস পার্টনারও ছিলেন। সে সময় তাকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়িও উপহার দিয়েছিলেন সেলিম। বিএনপি সরকার চলে গেলেও সেলিম প্রধান থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি সেলিম প্রধানের চলাফেরা দেখেই অনেকে হতভম্ব হয়ে যান। কারণ তার আশপাশে সবসময় স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ১০জন দেহরক্ষী থাকেন।
বিএনপি সরকারের সময় সেলিম প্রধান জাপানিদের অর্থায়নে জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলেন। সেখানে প্রায় সব ব্যাংকের চেক বইসহ ব্যাংকিং দলিলপত্র ছাপানো হতো। এই প্রিন্টিং ব্যবসার নামে তিনি একাধিক ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন। অর্থ আত্মসাতে তার সঙ্গে হাত মেলান কয়েকটি ব্যাংকের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা। একপর্যায়ে টাকা নিয়ে দেশের বাইরে চলে যান সেলিম।
স্থায়ী আবাস গড়েন জাপানের রাজধানী টোকিওতে। কিন্তু টোকিওতেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত হন। পরে জাপান থেকে বহিষ্কার করা হলে চলে যান আমেরিকায়। সেখানে এক আমেরিকানকে বিয়েও করেন। আমেরিকান স্ত্রীকে কাজে লাগিয়ে তিনি ফের জাপানে ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু এ যাত্রায়ও সফল হননি। সেলিম প্রধানকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। তবে তাকে বেশিদিন কারাবাস করতে হয়নি। এরপর গুলশানের একটি স্পা সেন্টার ঘিরে তিনি নতুন করে নেটওয়ার্ক গোছানোর কাজ শুরু করেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, সেলিম প্রধানের ৩৩ নম্বর রোডের স্পা সেন্টারটি একসময় চালাতেন কয়েকজন জাপানি নাগরিক। তাদের সঙ্গে সখ্য থাকার সুবাদে তিনি জাপান যাওয়ার টিকিট পান। কিন্তু তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করে জাপানিদের কাছ থেকে স্পা সেন্টার দখল করে নাম দেন ‘প্রধান স্পা’।
এরপর থেকে বিশ্বের একাধিক দেশে তার শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ। অথচ স্পা ব্যবসা ছাড়া দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস নেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাসে অন্তত ১০০ কোটি টাকা ব্যাংককসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়েই সেলিম প্রধান অবাধে ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু করেন। অবৈধ এসব ব্যবসা ছাড়াও চাঁদাবাজি থেকেও কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন তিনি।
থাই এয়ারওয়েজে করে ব্যাংকক যাওয়ার সময় সোমবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ থেকে সেলিম প্রধানকে আটক করে র্যাব। পরে তাকে নিজেদের হেফাজতে নেয় র্যাব। এরপর তার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীটি।
র্যাবের তথ্যানুযায়ী, উত্তর কোরিয়ান নাগরিক মি. দো এর সঙ্গে ৫০-৫০ পার্টনারশিপে পি-২৪ এবং টি-২১ নামে দুইটি অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনা করতেন সেলিম প্রধান। যা তার মালিকানাধীন প্রধান গ্রুপের ওয়েবসাইটেও স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।
অনলাইনে ক্যাসিনো খেলতে চাইলে প্রথমে যেকোনো একটি গেমিং সফটওয়্যার মোবাইলে ইনস্টল করতে হতো। এরপর সেসব সফটওয়্যারে প্রবেশ করলে বিভিন্ন ধরনের গেমস দেখা যেত। ওই গেমসগুলোতে পুরোপুরি বাংলায় নির্দেশনা দেয়া রয়েছে যাতে করে কোনো খেলোয়ারের বুঝতে সমস্যা না হয়।
ওই গেমে প্রবেশ করতে গ্রাহককে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যকাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ডের প্রয়োজন হয়। নির্ধারিত গেমের জন্য নির্ধারিত টাকা থাকতে হতো অ্যাকাউন্টে। খেলা শুরুর পর নির্ধারিত ওই টাকা তিনটি অনলাইন ‘গেটওয়ে’তে জমা হতো। গ্রাহক খেলায় জিতলে টাকা অ্যাকাউন্টে ফেরত যেত, অন্যথায় গেটওয়েতে থেকে যেত।
এরপর প্রতি সপ্তাহে সেলিম প্রধানের সহকারী আক্তারুজ্জামান সেসব গেটওয়ে থেকে টাকাগুলো তিনটি অ্যাকাউন্টে জমা করতেন। এরপর সেসব টাকা হুন্ডি অথবা ব্যক্তির মাধ্যমে লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যেত।
মঙ্গলবার বিকেলে সেলিম প্রধানের বাসা ও অফিসে অভিযান শেষে এসব তথ্য জানান র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম।
তিনি বলেন, র্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল ধারাবাহিক তদন্তে জানতে পারে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনলাইনে ক্যাসিনো পরিচালনা করে আসছে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব অপারেশনের প্ল্যান করে। এর মধ্যেই খবর পাই অনলাইন ক্যাসিনোর মূলহোতা সেলিম প্রধান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। তাৎক্ষণিক ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে থাইল্যান্ডগামী একটি ফ্লাইট থেকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হই। এরপর সোমবার সন্ধ্যায় সেলিম প্রধানের বাসা ও অফিসে অবস্থান নিই। পুরো প্রক্রিয়াটিকে তদন্ত করে বের করতে অনেক সময় লেগেছে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, এ অভিযানে তার বাসা ও অফিস থেকে ৪৮টি বিদেশি মদের বোতল, ২৯ লাখ টাকা, ২৩টি দেশের মোট ৭৭ লাখ সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা, ১২টি পাসপোর্ট, ২টি হরিণের চামড়া, ২৩টি ব্যাংকের ৩২টি চেক, চারটি ল্যাপটপ এবং অনলাইন গেমিং পরিচালনার একটি বড় সার্ভার জব্দ করা হয়েছে।
আটক সেলিম প্রধানকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালে রাজধানী ঢাকায় জন্ম সেলিমের, ১৯৮৮ সালে ভাইয়ের সহযোগিতায় জাপান যান তিনি। এরপর সেখানে গাড়ির ব্যবসা শুরু করেন সেলিম। একপর্যায়ে জাপান থেকে থাইল্যান্ডে এসে শিপ ব্রেকিংয়ের ব্যবসা করেন। এরপর অনলাইন ক্যাসিনোর কিং হন তিনি। সেখানে উত্তর কোরিয়ান নাগরিক মি. দো-এর সঙ্গে পরিচয় হয় সেলিমের। মি. দো বাংলাদেশে সেলিমের মাধ্যমে বিনিয়োগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং অনলাইনে ক্যাসিনো ব্যবসার পরামর্শ দেন। তার ব্যবসায়িক সব নথি পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে। সেখানে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, মি. দো এবং সেলিমের ফিফটি-ফিফটি পার্টনারশিপ রয়েছে।
গত ১ বছর ধরে অনলাইনে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিল সেলিম প্রধান। এই সময়টাতে কি পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছেন এবং বিদেশে পাচার করেছে তা তদন্ত করে পরে জানানো হবে বলেও জানান র্যাব-১ অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম।
সর্বশেষ বুধবার ভোরে তার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মানিলন্ডারিং ও মাদকদ্রব্য আইনে দুটি মামলা করে র্যাব। এর আগে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। মামলায় সেলিম প্রধানের দুই সহযোগী আক্তারুজ্জামান ও রহমানকেও গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, সোমবার দুপুরে সেলিম প্রধানকে গ্রেফতার করা হয়। পরে গুলশান-২ নম্বরের ৯৯ নম্বর রোডের ১১/এ ছয়তলা বাসায় অভিযান চালানো হয়। এছাড়া বনানীতে তার ব্যবসায়িক অফিসে অভিযান চালায় র্যাব।
অভিযানে ৪৮টি মদের বোতল, ২৯ লাখ পাঁচ হাজার ৫০০ নগদ টাকা, ২৩টি দেশের বৈদেশিক ৭৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা সমমূল্যের মুদ্রা ও ১৩টি ব্যাংকের ৩২টি চেক, অনলাইন ক্যাসিনো খেলার মূল সার্ভার, আটটি ল্যাপটপ এবং দুটি হরিণের চামড়া জব্দ করা হয়।
সেলিম প্রধানের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার মুর্তুজাবাগে। তার বাবার নাম আব্দুল হান্নান ওরফে নান্নু মিয়া। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার বড় সেলিম।