দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে প্রধানমন্ত্রী
চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবার আমলনামা এখন তার কাছে। বিতর্কিত কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধেও অ্যাকশন শুরু হবে।
জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকে আজকে প্রকাশিত সাংবাদিক মেহেদী হাসানের করা একটি বিশেষ প্রতিবেদনে দলীয় সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, গত শনিবার গণভবনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তিন বছরে মাত্র একটি জেলায় সম্মেলন হওয়ায় কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘এই মেয়াদে মাত্র একটি জেলায় সম্মেলন হলো কেন? বাকিগুলো কেন হলো না? আপনারা করেন কী? কে কী করেন সবার আমলনামা কিন্তু আমার কাছে রয়েছে। জেলায় জেলায় গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে আসেন, দলের কাজ তো কেউ করেন না। ব্যক্তি অপকর্মের দায় দল ও সরকার নেবে না। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি কেন্দ্রীয় নেতারা। এ সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় ১২ নেতাকে এসি রুমের মধ্যে বারবার ঘাম মুছতে দেখা যায় বলে বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা ইত্তেফাককে জানান।
জানা গেছে, টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর দল ও সরকারের ইমেজ রক্ষায় এবার আর কোনো ছাড় নয়। অনিয়ম, দুর্নীতি ও দলের গঠনতন্ত্র, নীতি-আদর্শবিরোধী যে কোনো কর্মকাণ্ড করলেই ছাড় পাবেন না কেউই। জাতীয় সম্মেলনের আগে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোয় একটা গুণগত পরিবর্তন আনতে কঠোর অবস্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অনৈতিক অভিযোগের বিরুদ্ধে তার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির অংশ হিসেবে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই পদ থেকে শোভন-রাব্বানীকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে যুবলীগকেও শেষ বারের মতো সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় যুবলীগের ট্রাইব্যুনাল চাঁদাবাজদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছে। এদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্সনীতি বাস্তবায়ন শুরু হওয়ায় দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিতর্কিত নেতাকর্মীদের মধ্যে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বিতর্কিত মন্ত্রী-এমপিসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও।
২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী ২০তম জাতীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই হিসেবে আগামী ২৩ অক্টোবর বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। তবে গত শনিবার আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে আগামী ২০-২১ ডিসেম্বরে জাতীয় সম্মেলনের তারিখ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্তমান কমিটির মেয়াদ বর্ধিত করা হয়েছে।
এদিকে তিন বছরে এখন পর্যন্ত মাত্র একটি সাংগঠনিক জেলায় সম্মেলন হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর মৌলভীবাজার জেলার সম্মেলন হয়। বাকি ৭৭টি সাংগঠনিক জেলা কমিটিই এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। এসব জেলায় সম্মেলনের জন্য সময় রয়েছে মাত্র তিন মাস। এখনো পর্যন্ত সম্মেলনের তারিখই ঘোষণা করা হয়নি। গত রবিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি এক বিবৃতিতে দলের সাংগঠনিক জেলা/ মহানগর /উপজেলা/ থানা/ পৌর/ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড-এর সব মেয়াদোত্তীর্ণ শাখার সম্মেলন আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের পক্ষে প্রেরিত এক চিঠিতে এই সাংগঠনিক নির্দেশনা প্রদান করেন। আগামীকাল বুধবার বিকাল ৩টায় আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের আগে ৫৮টি সাংগঠনিক জেলায় সম্মেলন হয়েছিল।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী হওয়া সারাদেশে দলের ১৭৭ নেতার কাছে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যাদের নামে চিঠি গেছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের চিঠির জবাব দিতে হবে। চিঠির জবাব পাওয়ার পর প্রতিটি উপজেলার বিষয়গুলো বিস্তারিত বিশ্লেষণের পর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা চিঠির জবাব দেবেন না, তাদের সরাসরি দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। জানা গেছে, বিদ্রোহীদের জবাবের তথ্য বিশ্লেষণ করে যদি কোনো কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী-এমপির সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিদ্রোহীদের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘গত ১২ জুলাই ২০১৯ তারিখে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক আপনাকে জানানো যাচ্ছে যে, আপনার বিরুদ্ধে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং নানাবিধ তত্পরতাসহ সংগঠনের শৃঙ্খলাবিরোধী ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যে কারণে গঠনতন্ত্রের ৪৭ (ক) ধারা অনুযায়ী আপনার বিরুদ্ধে কেন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এ বিষয়ে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রেরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হলো।
সূত্র জানায়, কেবল ছাত্রলীগ-যুবলীগ নয়, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ ও তার প্রমাণ দলীয় হাইকমান্ডের কাছে আছে। কাউকে ছাড়বেন না তিনি। শুধু সাংগঠনিক ব্যবস্থা নয়, আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। তৃণমূলে যাদের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দলেও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। দুর্নীতিবাজ-চাঁদাবাজদের মদত না দিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। নেতাকর্মীদের কাছে আরো দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করছেন তিনি। রাজনীতির নামে কোনো রকম বিশৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি, পেশিশক্তি প্রয়োগ ইত্যাদির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছেন শেখ হাসিনা।
টানা তিন মেয়াদের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা এখন দল নিয়ে খুবই সিরিয়াস। তিনি চান না, তার নেতৃত্বাধীন সরকারের অর্জন দলীয় কিছু নেতাকর্মীর আচরণের কারণে ম্লান হয়ে যাক। এক্ষেত্রে যত বড়ো নেতাই হোক রক্ষা পাবেন না। সরকার পরিচালনার পাশাপাশি দল ও সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের বিভিন্ন সূত্র এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিং করছেন তিনি। বিশেষ করে মন্ত্রিসভার সব সদস্য, এমপি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ব্যাপারে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করছেন শেখ হাসিনা। তাদের অনেকের আমলনামা শেখ হাসিনা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন। যে কোনো সময় বিতর্কিতদের কপাল পুড়বে।