বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করেছে ৬৬ গার্মেন্টস

বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধার আওতায় পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রির সঙ্গে জড়িত ৬৬টি গার্মেন্টস কারখানাকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন অফিসের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহের শুরুতে তালিকাটি গার্মেন্টস শিল্প-মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর কাছে পাঠিয়ে দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্যপদ বাতিলের অনুরোধ জানিয়েছে এনবিআর।

সূত্র জানায়, তালিকায় অভিযুক্ত গার্মেন্টসের মধ্যে সুপরিচিতি এসকিউ সেলসিয়াসের মতো একাধিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এছাড়া ১০টি প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে, যেগুলো একাধিকবার খোলাবাজারে বিক্রিকালে ধরা পড়েছে। দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, ‘অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে আমরা বিশদ পরীক্ষা করবো। এরপর দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আমরা চাইনা অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানের কারণে পুরো গার্মেন্টস খাত ক্ষতিগ্রস্ত হোক।’

কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিস সূত্র জানিয়েছে, বিজিএমইএকে পাঠানো তালিকার বাইরেও বন্ড অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের আরেকটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ইস্যুটি নিয়ে অর্থমন্ত্রীও তত্পর। বন্ডেড সুবিধায় মালামাল এনে তা খোলা বাজারে বিক্রি করে দেওয়ায় এবং স্থানীয় বস্ত্রশিল্পের প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ নিয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে তিনি এনবিআর কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটকেও নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এ সুবিধা রাখা না রাখা নিয়েও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা চলছে।

কাস্টমস বন্ড কমিশনার এস এম হুমায়ুন কবীর ইত্তেফাককে বলেন, যে প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা পাঠানো হয়েছে তাদের হাতেনাতে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন সময় রাতে অভিযান চালিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকা থেকে খোলাবাজারে বিক্রির সময় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই তাদের অপরাধ স্বীকার করে জরিমানার অর্থ পরিশোধ করেছে।

শতভাগ রপ্তানিকারকদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিয়েছে সরকার। তবে শর্ত হলো এ সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামাল এনবিআর নির্ধারিত গুদামে রেখে তা দিয়ে তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে হবে। এটি বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা নামে পরিচিত। বন্ডেড সুবিধার কোনো পণ্য বাইরে বিক্রি করতে হলে সরকারের প্রযোজ্য শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু সরকারের দেওয়া এ সুবিধার অপব্যবহার করছে একশ্রেণির ব্যবসায়ী।

এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, বন্ডেড সুবিধায় আনা গার্মেন্টসের কাঁচামালের শুল্ক-করের পরিমাণ প্রকারভেদে ৬০ শতাংশ থেকে ১১০ শতাংশ কিংবা তার চাইতেও বেশি হারে পরিশোধ করতে হয়।

গার্মেন্টস রপ্তানিকারকরা ক্রেতার কাছ থেকে ক্রয়াদেশ পাওয়ার পর তাদের স্ব স্ব সংগঠন বিজিএমইএ কিংবা বিকেএমইএর কাছ থেকে শুরুতে প্রাপ্যতার ঘোষণা দেন। এটি ইউটিলিটি ডিক্লারেশন বা ইউডি নামে পরিচিত। এর ভিত্তিতে কাঁচামাল আমদানি করে পরবর্তী সময়ে নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় তার অনুমোদন নেন বন্ড কমিশনারেট অফিস থেকে যা ইউটিলিটি পারমিশন বা ইউপি নামে পরিচিত। তবে অনুমোদনের ক্ষেত্রে একটি মানদণ্ডকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। বন্ড কমিশনারেট অফিস সূত্র জানায়, ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী ক্রয়াদেশ বাড়তে পারে। ফলে রপ্তানিকারক তার ইউডি সংশোধন করেন। কিন্তু সংগঠনগুলো থেকে শুরুতে ইউডি’র যে তথ্য দেওয়া হয়, সংশোধন করে প্রাপ্যতা বাড়ানোর পর তা আর বন্ড কমিশনারেট অফিস জানতে পারে না। ফলে সংশোধনের নামে অনেক কারখানা বেশি পরিমাণে কাঁচামাল আমাদানি করে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়।

সূত্র জানিয়েছে, জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর শুল্ক-কর ফাঁকির তথ্যও পাঠানো হয়েছে বিজিএমইএ’র কাছে। এতে দেখা গেছে, কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিস ১৬টি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি ধরেছে যার মাধ্যমে ৩৫ কোটি ৩১ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। কাস্টমস গোয়েন্দা বিভাগ ১২টি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম উদ্ঘাটন করে ২৭৫ কোটি টাকা আদায় করেছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ ১টি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম উদ্ঘাটন করে আদায় করেছে যাতে রাজস্বের পরিমাণ ১৩ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান দায় স্বীকার করেছে। চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে যাতে রাজস্বের পরিমাণ ৪৪ কোটি টাকা। এছাড়া ঢাকা কাস্টম হাউজ ৩টি, বেনাপোল কাস্টম হাউজ ৮টি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি চিহ্নিত করেছে।

অভিযুক্ত ৬৬ গার্মেন্টস

বিজিএমইএ’র কাছে পাঠানো তালিকা অনুযায়ী অভিযুক্ত গার্মেন্টসের মধ্যে রয়েছে ঢাকার নিপা নিটওয়্যারস, সাভারের রেজা ফ্যাশন্স, গাজীপুরের ট্রাউজার ওয়ার্ল্ড, মোহাম্মদপুরের সেলিব্রেটি এক্সপোর্ট গার্মেন্টস, বটম গ্যালারি, সিনটেক্স টেক্সটাইল এস অ্যাপারেলস, গাজীপুরের কাশিমপুরের ইউটা নিটিং অ্যান্ড ডায়িং, মিরপুরের কার্ডিয়াল ডিজাইন, আল ইসলাম টেক্স, করতোয়া অ্যাপারেলস, কায়সার সানকো জেবিটেক্স, টিএনজেড অ্যাপারেলস, এপেক্স ল্যানজারিং, জেনেসিস ফ্যাশন্স, ল্যাভেন্ডার গার্মেন্টস।

তুরাগের মাসটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, রামপুরার আশিয়ানা গার্মেন্টস, টঙ্গীর কেপরি অ্যাপারেলস, খিলক্ষেতের নাফ ফ্যাশন্স, নারায়ণগঞ্জের মিশুয়ার হোসিয়ারি, চট্টগ্রামের অ্যাপারেল অপশন, ফ্যাশন ক্রিয়েট, ডিকে অ্যাপারেল, ক্যাসিওপিয়া সোয়েটারস, আইম্যান টেক্সটাইল, জেএবি লিমিটেড।

গাজীপুরের এম এইচ অ্যাপারেলস, এ আর এইচ নিট কম্পোজিট, ক্রস লাইন নিট ফেব্রিক্স, নিট বাজার, লেলফ ইনোভেটিভ, স্পারো অ্যাপারেল, আশুলিয়ার ডিজাইনার ফ্যাশন্স, চট্টগ্রামের গার্মেন্টস হোম, সুফী অ্যাপারেল, ময়মনসিংহের ভালুকার সুপ্তি সোয়েটার।

এছাড়া চট্টগ্রামের টিকেএম গার্মেন্টস, আদিল অ্যাপারেলস, ফোকাস অ্যাপারেলস, মনটেক্স অ্যাপারেলস, আজমাইন ফ্যাশন্স, প্রিটি অ্যাপারেলস, সার্ক গার্মেন্টস, ফ্যাশন ক্রিয়েট অ্যাপারেলস, এক্সিয়ম ফ্যাশন, ওশেন অ্যাপারেলস, টিম অ্যাপারেলস, এ এন্ড বি আউটওয়্যার, কর্ণফুলী ইপিজেডের হংকং ডেনিম, ভেনকট লিমিটেড, বেসটেক লিমিটেড, বিডি ডিজাইন, মেরিনা অ্যাপারেলস, টিএন্ডজেড অ্যাপারেলস, ওসিস ফ্যাশন্স। নরসিংদীর চরকা টেক্সটাইল, গাজীপুরের স্মাগ সোয়েটার, সাভারের ফেব্রিকা নিট কম্পোজিট, গাজীপুরের ইয়োর ফ্যাশন সোয়েটার, টাঙ্গাইলের ইমপ্রেস নিউটেক্স কম্পোজিট, নারায়ণগঞ্জের ফকির অ্যাপারেলস, গাজীপুরের এসকিউ সেলসিয়াস ও নরবান কমটেক্স লিমিটেড।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)